নিজস্ব প্রতিবেদ:
কুমিল্লা নগরীর প্রাচীন ও ঐতিহ্যবাহী রাজগঞ্জ বাজারে মুরগি বিক্রিতে ডিজিটাল কারচুপির সময় হাতে নাতে ধরা খেয়েছেন দুই বিক্রেতা। রাজগঞ্জ বাজারের আলু পট্টির মো: রাসেল মিয়া ও এসকে শরীফ পরিচালতি মেহেরাজ ব্রয়লার হাউজ নামের ওই দোকানে প্রতি মুরগে প্রায় তিনশ গ্রাম করে ওজনে চুরি করতেন তারা। তাদের পাল্লায় ওজন কত গ্রাম বেশি দেখাবে এমন পদ্ধতিতে বাটন সেট করা থাকে আগে থেকেই। মুরগরে পরিমান বুঝে ওজন বাড়িয়ে দেন তারা। ক্রেতার অভিযোগের ভিত্তিতে ব্যবসায়ী দোকান মালিক সমতিরি নেতাদের নিয়ে জরুরী বৈঠকে বসে ওই দোকান ১৫ দিনের জন্য বন্ধ রাখার ঘোষণা, দুই বিক্রেতা কর্মাচারীকে প্রকাশ্যে লাঠিপেটা করে ক্ষমা চাওয়ানো সহ ক্রেতাকে তার প্রাপ্য মুরগ দেয়ার পাশাপাশি দুই কর্মচারী বাজারের কোথাও আর চাকরি করতে পারবেনা বলে সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। তাছাড়া ক্রেতার কাছে ব্যবসায়ী সমিতির নেতারা দু:খ প্রকাশ করে ক্ষমা চান। দোকানের মালিক কুমিল্লার বাহিরে আছেন বলে তার বিরুদ্ধে আর কোন ব্যবস্থা গ্রহণ করেননি ব্যবসায়ী নেতারা।
জানা যায়, ১০ আগষ্ট বুধবার রাত ১০টার দিকে রাজগঞ্জ বাজারের আলু পট্টিতে সোনালী মুরগ কেনার জন্য ওই দোকানে যান সংবাদ কর্মী ও ব্যবসায়ী মো: এমদাদুল হক সোহাগ। দাম জেনে তিনি চারটি রাতা মুরগ বাছাই করে বিক্রেতা নিরব ও ফয়সালকে দোকানের ডিজিটাল পাল্লায় ওজন দিতে বলেন। ওজন দেয়ার সময় দাম নির্ধারণ করার কথা বলে ফয়সাল কৌশলে একটি বাটনে ক্লিক করে ওজন বাড়িয়ে ফেলেন, এতে চারটি মুরগের ওজন দাড়ায় ৪ কেজে চারশ গ্রাম যার দাম আসে ১১৭০ টাকা প্রায়। ওজন দেয়ার সাথে সাথে কিছু বুঝে ওঠার আগেই সেগুলো নামিয়ে জবাই শুরু করেন ফয়সাল। ড্রেসিংয়ের সময় মুরগের সাইজ ও ওজন নিয়ে ক্রেতার সন্দেহ প্রকট হয়। ড্রেসিংয়ের পর তাদের পাল্লায় পুনরায় মাপ দেয়ার পর পাওয়া যায় আড়াই কেজি। চার মুরগের দাম ১১৬০ টাকা পরিশোধ করে বিষয়টি সুস্পষ্ট বুঝতে পেরে ক্রেতা আবারো নতুন করে তিনটি বড় রাতা মুরগ দিতে বলেন। তখন আবারো তিনটি মুরগ পাল্লায় দেয়ার পর ফয়সাল নামের বিক্রেতা আবারো বাটনে ক্লিক করে ফেলেন সুযোগে, ফলে ওজন হয় চার কেজির কাছাকাছি। তখন ক্রেতা চ্যালেঞ্জ করে পুনরায় জিরো করে সঠিক মাপ দেয়ার কথা বলেন এবং ওজন হয় দুই কেজি নয়শ গ্রাম। তখন তিনি অন্যান্য ক্রেতা ও ব্যসায়ীদের দৃষ্টি আকর্ষণ করে ব্যবসায়ী নেতাদের ডাকার অনুরোধ করেন। শুরুতে বাজার কমিটির সহসভাপতি এসে পাল্লায় মুরগ থাকাবস্থায় কারচুপির বিষয়টি নিশ্চিত হয়ে সভাপতি-সাধারণ সম্পদককে জানান। পরে সভাপতির দোকানে দুই বিক্রেতাকে এনে জিঙ্গাবাদে তারা তাদের অপরাধ স্বীকার করেন। মালিকের সম্পৃক্ততা শুরুতে অস্বীকার করলেও পরিস্থিতি বেগতিক দেখে তারা শেষ পর্যন্ত মালিক রাসেলের সম্পৃক্ততার কথা স্বীকার করেন।
এসময় রাজগঞ্জ ব্যবসায়ী দোকান মালিক সমিতির সভাপতি তোফাজ্জল হোসেন ইদু মিয়া, সাধারণ সম্পাদক আজিকুর রহমান আজগর, যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক খন্দকার বাপ্পী সহ অন্যান্য নেতৃবৃন্দ-সাধারণ ব্যসায়ী, দৈনিক দেশ রুপান্তরের জেলা প্রতিনিধি সাংবাদিক নেতা দেলোয়ার হোসেন জাকির, অভিযুক্ত দোকানের মালিক রাসেলের পিতা মোস্তফা মিয়া প্রমুখ উপস্থিত ছিলেন। প্রায় এক ঘন্টা বিচারে ওই দোকানের মালিক এবং দুই বিক্রেতাকে চোর সাব্যস্ত করে দোকানটি ১৫ দিনের জন্য তালা মেরে বন্ধ রাখা, দুই বিক্রেতা কর্মচারীকে হালকা লাঠিপেটা ও কান ধরে ওঠবস করিয়ে ক্রেতার পায়ে ধরে ক্ষমা চাওয়ানো সহ ওজনে কম দেয়া মুরগী নতুন করে দেয়া হয়। পাশাপাশি রাজগঞ্জ ব্যাবসায়ী দোকান মালিকের পক্ষ থেকে ক্রেতাকে সঠিকভাবে বিষয়টি উপস্থাপন করার জন্য ধন্যবাদ জানিয়ে এমন কর্মকান্ডের জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করেন। ভবিষ্যতে ক্রেতাদের সাথে যেন এমন কাজ আর না করে সেজন্য নজরদারি বাড়ানোর আশ্বাস দেন তারা।
অভিযোগকারী ক্রেতা এমদাদুল হক সোহাগ জানান, আমি ওজনে চুরির বিষয়টি বুঝতে পেরে শুরুতে কিছু না বলে পুনরায় হাতেনাতে ধরে আশপাশের অন্যান্য ক্রেতা-ব্যবসায়ীদের জানিয়ে ব্যবসায়ী সমিতির নেতাদের আসতে অনুরোধ করি। পাশাপাশি বিষয়টি কোতয়ালী মডেল থানার অফিসার ইনচার্জকে বিষয়টি অবহিত করি। ওসি সাহেবের পরামর্শে শুরুতে বিষয়টি সমাধানের জন্য সমিতির নেতাদের কাছে উপস্থাপন করি। তারা বসে সবকিছু জেনে রায় দিয়েছেন। বাজার কমিটির সেক্রেটারি শুরতে তিন মাস দোকান বন্ধ রাখার কথা বললেও মানবিক দিক বিবেচনায় পরে সবাই সেটা ১৫দিন করার বিষয়ে একমত হন। আমি তাদের তাদের রায় মেনে ভবিষ্যতে অন্যান্য ক্রেতাদেরকে যেন আর ঠাকানো না হয় সেজন্য মুরগির দোকানে নজরদারি বাড়ানোর অনুরোধ জানাই এবং কোতয়ালী মডেল থানার ওসিকে সেখানে বসেই বিচারের ফয়সালা জানিয়ে চলে আসি।
এদিকে, রাতে বিষয়টি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে প্রকাশিত হলে কুমিল্লা সচেতন নগরবাসী যারা রাজগঞ্জ বাজারে প্রতিনিয়ত বাজার করেন তাদের অভিযোগের হিরিক পরে। অভিযোগকারী ক্রেতার টাইম লাইনে বিষয়টির আদ্যোপান্ত তুলে ধরলে সেখানে সরকারি-বেসরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারী, ডাক্তার, প্রকৌশলী, সাংবাদিক, রাজনীতিবিদ, শিক্ষার্থী, সুশীল ও বিভিন্ন পেশার মানুষ তাদের সাথে হয়ে যাওয়া ওই বাজারের তিক্ত অভিজ্ঞতা ও অনুভূতি শেয়ার করেন। পাশাপাশি এমন সাহসী ও বিচক্ষণ পদক্ষেপের জন্য এমদাদুল হক সোহাগকে ধন্যবাদ জানান। বৃহস্পতিবার সকাল থেকে বিষয়টি টক অব দ্যা টাউনে পরিণত হয়। অভিযোগকারীরা বলেন, এসব অসৎ ব্যসায়ীরা প্রতিনিয়ত ক্রেতাদের ঠকিয়ে যাচ্ছেন। দ্রব্যমূল্যের উর্ধ্বগতির সাথে এভাবে চুরি করে ওজন বাড়িয়ে দাম রাখলে সাধারণ মানুষ কোথায় যাবে। এসব কর্মকান্ডের কঠিন শাস্তি দাবি করেন তারা।
ভোক্তা অধিকারের কুমিল্লা জেলার সহকারী পরিচালক আছাদুল ইসলাম রাতে এক বার্তায় ধন্যবাদ জানিয়ে বলেন, ক্রেতাদের আগে সচেতন হতে হবে। সবাই এভাবে সচেতন হয়ে জেগে ওঠলে ভোক্তার অধিকার প্রতিষ্ঠিত হবেই। আইন প্রয়োগেরও প্রয়োজন হবেনা।
বাজার কমিটির সাধারণ সম্পাদক আজিকুর রহমান আজগর বলেন, ক্রেতাদের সচেতন হতে হবে আগে। মুরগি ওজনে কম দেয়ার বিষয়টি নিয়ে দীর্ঘদিন ধরে ক্রেতাদের অভিযোগ শোনতে শোনতে আমরা তিক্ত হয়ে গেছি। আলু পট্টির অভিযোগ সবচেয়ে বেশি। কমিটির পক্ষ থেকে কোতয়ালী মডেল থানায় আমরা একটি মামলাও করেছি। সাংবাদিক সাহেব একজন ভদ্র মানুষ। তিনি বিষয়টি বুঝতে পেরে প্রমাণ সহ হাতেনাতে বিচার দিয়েছেন। আমরা তাৎক্ষনিক বসে বিষয়টির বিচার করে দিয়েছি। এতে করে অন্যান্য যারা আছে তারাও সতর্ক হবেন।
কোতয়ালী মডেল থানার অফিসার ইনচার্জ মো: সহিদুর রহমান জানান, সাংবাদিক এমদাদুল হক সোহাগ ভাই রাতে আমাকে বিষয়টি মুঠোফোনে জানান। আমি বলেছি আগে ব্যবসায়ি সমিতিকে জানানোর জন্য। যদি তারা না পারে তাহলে আমরা আইনগত ব্যবস্থা নিবো এবং থানা থেকে ফোর্স পাঠাবো। বিষয়টি নিয়ে মুঠোফোনে সভাপতির সাথেও আমার কথা হয়েছিল। পরে সাংবাদিক সাহেব জানিয়েছেন ব্যবসায়ী নেতারা বসে বিচার করেছেন এবং তিনি বিচার মেনে নিয়েছেন।
অপরদিকে ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের কুমিল্লা জেলার সহকারি পরিচালক আছাদুল ইসলাম বৃহস্পতিবার সকাল থেকে দুপুর পর্যন্ত রাজগঞ্জ বাজারের প্রায় ত্রিশটি দোকানে অভিযান পরিচালনা করেন। এসময় বিভিন্ন অপরাধে কয়েকটি দোকানিকে জরিমানা করা হয়।