এমদাদুল হক সোহাগ
একতলা বাড়ির চার-পাঁচটি রুমের মধ্যে দুইটা ফ্রিজ, দুইটা এসি থাকলেও একটা চালানো হয় না, আরেকটি দিনে চার-পাঁচ ঘন্টা চলে আর কিছু ফ্যান ও বাল্ব। তাতেই প্রতি মাসে পাঁচ থেকে আট হাজার টাকা করে বিল আসতো কুমিল্লা সরকারি মহিলা কলেজের সাবেক অধ্যক্ষ প্রফেসর জোহরা আনিসের ঝাউতলা মেইন রোডের ‘গ্রিনউড ভ্যালি’ নামীয় বাসাতে।
বিদ্যুৎ অফিসে যাওয়া-আসা, যোগাযোগ-অভিযোগ ঝামেলা এড়াতে যা বিল আসছে, তা-ই পরিশোধ করে আসছিলেন রত্নগর্ভা মা ও বেগম রোকেয়া পদকপ্রাপ্ত সাবেক এই অধ্যক্ষ।
গত বছর অর্থাৎ ২০১৯ সালের অক্টোবর মাসে বিল পরিশোধ করেছেন ৮৭৩৫ টাকা, নভেম্বর মাসে পরিশোধ করেছেন ৮৭৩৪ টাকা, ডিসেম্বর মাসে করেছেন ৫৩৬৩ টাকা। অথচ পরের মাসে অর্থাৎ ২০২০ সালের জানুয়ারি মাসে বিল আসে ৯৬ হাজার ৭২৭ টাকা!
বিল দেখে যে কারোরই থমকে যাওয়ার কথা বা ছোখ কপালে উঠার কথা! শুধু এখানেই শেষ নয়, জানুয়ারী মাসের বিল সংশোধন না করে জানুয়ারী, ফেব্রুয়ারী, মার্চ ও এপ্রিল মাস মিলিয়ে কুমিল্লা শাসনগাছা বিদ্যুৎ অফিস (এসএনডি-১) থেকে জোহরা আনিসের বাসায় বিল পাঠানো হয়েছে এক লাখ ৬৫ হাজার ২০১ টাকা।
নিরুপায় হয়ে ভৌতিক ও অবান্তর বিল নিয়ে আপত্তি জানিয়ে তা সংশোধন করার জন্য নির্বাহী প্রকৌশলী ছানাউল্লা মিয়া বরাবর আবেদন করেছিলেন প্রফেসর জোহরা আনিস। তার আবেদনের প্রেক্ষিতে বলা হয়েছে, মিটারে রিডিং যা ছিলো, সে হিসাব অনুযায়ীই বিল হয়েছে। মিটার রিডার বাসায় না গিয়ে ঠিকমতো রিডিং না নেয়াতে আগের বিলগুলোতে ইউনিট কম দেখানোর কারণে অনেক ইউনিট জমে গেছে। ডিসেম্বরে মিটার চেক দেয়ার পর দেখা গেছে বিদ্যুত বিভাগ ওই মিটারের বিপরীতে ৯৬ হাজার ৭২৭ টাকা পাওনা হয়েছে!
অন্যদিকে, জানুয়ারী, ফেব্রুয়ারী, মার্চ ও এপ্রিল মাসের বিলে ভুল হয়েছে সেগুলো কারেকশন করে এক লাখ ৬৫ হাজার ২০১ টাকা থেকে কমিয়ে এক লাখ ১৬ হাজার টাকা করে দিয়েছেন নির্বাহী প্রকৌশলী ছানাউল্লাহ মিয়া।
নির্বাহী প্রকৌশলীর এই সিদ্ধান্তকে অযৌক্তিক মনে করে বিদ্যুৎ অফিসের মিটার পরীক্ষা করে প্রকৃত ব্যবহারের উপর ভিত্তি করে বিদ্যুত বিল করার লিখিত আবেদন করেন প্রফেসর জোহরা আনিস।
আবেদনে তিনি বলেন, গত বছরের বিলের সাথে এ বছরের বিলের কোন সামঞ্জস্য নেই বরং তা রীতিমতো ভৌতিক।
প্রফেসর জোহরা আনিসের ছেলে, প্রখ্যাত নাক কান গলা বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক ও সার্জন ডা: আরিফ মোর্শেদ খান বলেন, আমাদের বাসায় দুটি ফ্রিজ ও দুটি এসি রয়েছে। বাবার রুমের একটি এসি চালানো হয় না, যেহেতু বাবার শ্বাসের সমস্যা। আরেকটি এসি আমার চেম্বারে। আমি দিনে চার পাঁচ ঘন্টা চেম্বার করি আর শুধু ওই সময়টাতে মাত্র এক টনের এসি ব্যবহার করা হয়। করোনাকালে তাও ব্যবহার করা হয় না চেম্বার বন্ধ থাকায়। তাছাড়া, ঘরে ও চেম্বারে স্বাভাবিক বাসা বাড়ির লাইট ফ্যান চলে। এতে করেই প্রতিমাসে পাঁচ থেকে আট হাজার টাকা বিল দিয়ে আসছিলাম। কিন্তু গত ডিসেম্বর মাসে যেখানে ৫৩৬৩ টাকা বিল পরিশোধ করলাম এবং ওই বিলে কোথাও বকেয়া লেখা নেই তারপরেও কিভাবে এবছরের জানুয়ারী মাসে ৯৬ হাজার ৭২৭ টাকা আসে ? শুধু জানুয়ারী না ফেব্রুয়ারী, মার্চ, এপ্রিল মাস মিলিয়ে এক লাখ ৬৫ হাজার ২০১ টাকার বিলে আমরা স্তম্ভিত হয়েছি। এখানে বিদ্যুত অফিসের মিটার রিডার যদি না এসে মনগড়া বিল করে থাকে, সেখানে আমাদের দোষটা কোথায়? তাছাড়া ছোট আবাসিক বাসয় এত টাকা বিল আসবেই বা কেন? আমার বাসার ভেতরে তো মিল ফ্যাক্টরি নাই। আমি নিজে নির্বাহী প্রকৌশলীর কাছে গিয়েছি। সারা দেশের ন্যায় ফেব্রুয়ারী, মার্চ, এপ্রিলের বিলে ‘ভুল হয়েছে’ বলে মোট বিল ১ লাখ ৬৫ হাজার ২০১ টাকা থেকে কমিয়ে ১ লাখ ১৬ হাজার টাকা বিল করে দিয়েছেন। বিদ্যুৎ অফিসের এই আচরণে আমরা হতাশ। এত টাকার বিল কোন ভাবেই আসতে পারে না। সেজন্য তাদের মিটার পরীক্ষা করার জন্য আবেদন করেছি এবং বিল সংশোধন করে প্রকৃত ব্যবহারের উপর ভিত্তি করে নতুন বিল দেয়ার অনুরোধ জানিয়েছি।
বেগম রোকেয়া পদক প্রাপ্ত প্রফেসর জোহরা আনিস বলেন, আমার বয়স হয়েছে। এই বয়সে বিদ্যুত অফিসে দৌড়ানোর মতো অবস্থা নেই। আমার ছোট একটি বাসায় তারা পাঁচ থেকে আট হাজার টাকা করে বিল দিয়েছে। আমরা রীতিমতো পরিশোধ করেছি। কিন্তু ডিসেম্বরে ৫৩৬৩ টাকা হলে জানুয়ারীতে ৯৬ হাজার ৭২৯ টাকা কিভাবে হয়? এটাই মাথায় আসেনা। করোনা মহামারিতে এমনিতে ভয় ও আতংকে দিন কাটছে। তাঁর মধ্যে বিদ্যুত অফিসের ভৌতিক বিলে আমি রীতিমতো বিস্মিত হয়েছি। এটা কোন ভাবেই মেনে নেয়ার মতোনা। এটা অন্যায়।
উল্লেখ্য, মহামারি করোনা ভাইরাসের প্রাদুর্ভাবে সারা দেশের ভুতুরে বিলের ন্যায় কুমিল্লা নগরীতেও গ্রাহকদের ভুতুরে বিল দিয়ে হয়রানি করেছে কুমিল্লা শাসনগাছা বিদ্যুৎ অফিস। অনেক গ্রাহক সময়ের অভাবে ও করোনার ভয়ে কোন অভিযোগ না করে তাদের ভুতুরে বিল পরিশোধ করেছে। মিটারের ব্যবহৃত ইউনিট থেকে অনেক বেশি ইউনিট দেখিয়ে অসামাঞ্জস্যপূর্ণ বিল প্রদান করা হয়েছে।
এসব বিষয় নিয়ে কুমিল্লার স্থানীয় ও জাতীয় মিডিয়ায় সংবাদ পরিবেশন করা হলেও কোন ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়নি। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেইসবুকে বিলের কপি সহ বিগত মাস ও করোনাকালীন মাসের বিলের কপি সংযুক্ত করে ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন। তাদের কথা করোনাকালীন মাসে বিদ্যুত বিল অন্য মাসের তুলনায় অনেক বিশি এবং অনেক ক্ষেত্রেই দ্বিগুন ও তিনগুণ বিল হয়েছে।
কুমিল্লা নগরীর রেইসকোর্স, বাগিচাগাঁও এলাকার বাসিন্দাদের অভিযোগ, বিদ্যুত অফিসের লোকজন না এসেই মনগড়া বিল করেছেন, আগের মাসগুলোর চেয়ে অনেক বেশি।
পশ্চিম বাগিচাগাঁও এলাকার আলহাজ্ব এমরান হোসেন বলেন, আমার বাসার কয়েকটি মিটারে যে ব্যবহৃত ইউনিট ছিলো, তার চেয়ে অনেক বেশি বিল দিয়েছে। আমি বিদ্যুৎ অফিসে যাওয়ার পরও তা সংশোধন না করে আগামি মাসে কমিয়ে দিবেন বলেছেন।
একই এলাকার ফাহমিদা আক্তার বলেন, করোনার কারণে আমরা পরিবার নিয়ে গ্রামে ছিলাম। এই সময়ে বাসা তালা ছিলো। তারপরেও বিদ্যুৎ বিল ফেব্রুয়ারী মাসের চেয়ে দ্বিগুণ এসছে। এমন বহু অভিযোগ রয়েছে শাসনগাছা বিদ্যুৎ অফিসের বিরুদ্ধে।
এবিষয়ে বক্তব্য জানতে চেয়ে শাসনগাছা বিক্রয় ও বিতরণ বিভাগের নির্বাহী প্রকৌশলী ছানাউল্লাহ মিয়ার মুঠোফোন নাম্বারে দুইদিন কল করার পরও কল রিসিভ না করায় বক্তব্য পাওয়া যায়নি।
এদিকে, গত ৬ জুলাই ভার্চুয়াল সংবাদ সম্মেলনে বিদ্যুৎ সচিব ড. সুলতান আহমেদ এসব কথা জানান, করোনাকালে ভূতুড়ে বিদ্যুৎ বিল তৈরির সঙ্গে সম্পৃক্ত থাকায় ৪টি বিদ্যুৎ বিতরণ কোম্পানির ২৯০ জন কর্মকর্তা-কর্মচারীর বিরুদ্ধে শাস্তির সুপারিশ করে বিদ্যুৎ বিভাগ। একই সঙ্গে জুন মাসের বিলের সঙ্গে অতিরিক্ত বিলের সমন্বয় করারও নির্দেশনা দেয়া হয়।
কুমিল্লার গ্রাহকেরা দীর্গদিন ধরে এভাবে হয়রানির শিকার হলেও কুমিল্লার বিদ্যুত কর্মকর্তাদের বিষয়ে কোন ব্যবস্থা নেয়ার খবর পাওয়া যায়নি।