প্রশিক্ষণের নামে নিষেধাজ্ঞা অমান্য করে সরকারি কর্মকর্তাদের বিদেশ ভ্রমণ থেমে নেই। চরম ডলার সংকটের এই সময়েও সরকারি কর্মকর্তাদের বিদেশ ভ্রমণ-ই যেন থামানো যাচ্ছে না। নানা ফাঁকফোকর বের করে তারা এ-সংক্রান্ত প্রস্তাবের সার-সংক্ষেপ অনুমোদন করে নিতে সক্ষম হচ্ছেন।
এ ছাড়া যে কাজে যাদের যাওয়ার কথা নয়, তাদের নাম থাকে একেবারে তালিকার শীর্ষে। এ ধরনের একটি বিদেশ ভ্রমণের প্লেজার ট্রিপে যাচ্ছেন মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের অধীনে কর্মরত ২০ কর্মকর্তা।
জলবায়ু স্থিতিস্থাপক অভিযোজন এবং মৎস্য ও জলজ খাতের ব্যবস্থাপনা পদ্ধতির প্রশিক্ষণ কর্মসূচিতে যোগ দিতে ইন্দোনেশিয়া যাবেন তারা। এ-সংক্রান্ত সরকারি আদেশে ১৩ মার্চ থেকে ২৪ মার্চ পর্যন্ত তাদের সেখানে অবস্থানের কথা উল্লেখ থাকলেও ১৮ মার্চ ২০ জনের এই দল ইন্দোনেশিয়ার উদ্দেশে ঢাকা ত্যাগ করবে।
তালিকার এক নম্বরে খোদ মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রী শ. ম. রেজাউল করিমের একান্ত সচিব (পিএস) ও চার নম্বরে রয়েছে সচিব ড. নাহিদ রশীদের পিএসের নাম। মন্ত্রণালয়ের নির্ভরযোগ্য সূত্রগুলো জানায়, সরকারি আদেশে দুই থেকে পাঁচ নম্বর পর্যন্ত যাদের নাম রয়েছে তাদের মধ্যে দুজন যুগ্মসচিব ও তিনজন উপসচিব পদমর্যাদার কর্মকর্তা। যেকোনো সময় তারা বদলি হয়ে অন্য মন্ত্রণালয়ে চলে যেতে পারেন। তাই তাদের এই প্রশিক্ষণ মৎস্য সেক্টরের চাষি পর্যায়ে কোনো কাজে আসবে না।
অথচ তারা সবাই প্রভাব খাটিয়ে প্রশিক্ষণের নামে এই বিদেশ ভ্রমণের সুযোগ বাগিয়ে নিয়েছেন। এ ছাড়াও মন্ত্রণালয়ের সচিবের নেতৃত্বে চার সদস্যের আরেকটি দল ইন্দোনেশিয়ার বালিতে স্টাডি ভিজিটে যাবে বলে জানা গেছে।
এ-সংক্রান্ত প্রস্তাবনা প্রধানমন্ত্রীর দপ্তরে পাঠানোর প্রক্রিয়া চলছে। অধিদপ্তরের একজন শীর্ষ কর্মকর্তা এই তথ্য নিশ্চিত করেছেন। তিনি জানান, প্রধানমন্ত্রীর অনুমোদন পেলেই এই চারজনের যাওয়ার বিষয়টি চূড়ান্ত হবে। তবে শেষ পর্যন্ত দ্বিতীয় সফরটির নীতিগত অনুমোদনও শিগগির হবে বলে মনে হচ্ছে।
প্রসঙ্গত, করোনাকালীন সংকটের পর থেকে সরকারি কর্মকর্তাদের বিদেশ ভ্রমণের ক্ষেত্রে বিধিনিষেধ আরোপ করে প্রজ্ঞাপন জারি করে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়। চিকিৎসা ও অতিজরুরি কারণ ছাড়া সেমিনার ও প্রশিক্ষণের নামে সরকারি কর্মকর্তাদের বিদেশ সফরকে নিরুৎসাহিত করে জারি করা নিষেধাজ্ঞা এখনো বলবৎ আছে। এর পরও ২০ কর্মকর্তার বহরকে বিদেশ যাওয়ার সরকারি আদেশ দেওয়া হয়েছে।
জানতে চাইলে মৎস্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক খন্দকার মাহবুবুল হক যুগান্তরকে বলেন, ‘জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে হাওড় ও সুন্দরবন এলাকার মৎস্যচাষিদের ওপর কী ধরনের নেতিবাচক প্রভাব পড়বে সে সম্পর্কে প্রশিক্ষণ নিতে কর্মকর্তারা বিদেশ যাবেন।
এ-সংক্রান্ত সরকারি আদেশ ইতোমধ্যে জারি হয়েছে।’ বিদেশ ভ্রমণের তালিকায় থাকা প্রথম পাঁচজনকে কোন বিবেচনায় সুযোগ দেওয়া হলো এবং তাদের এ প্রশিক্ষণ চাষি পর্যায়ে কাজে আসবে কিনা-এমন প্রশ্নের কোনো সদুত্তর দেননি তিনি। অপর এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘এই সফরে সরকারি তহবিলের অর্থ খরচ হবে না। প্রশিক্ষণে অংশ নেওয়ার জন্য কর্মকর্তাদের সব খরচ ফুড অ্যান্ড এগ্রিকালচার অর্গানাইজেশন (এফএও) বহন করবে।
ফলে প্রত্যেক কর্মকর্তা যে অর্থ বরাদ্দ পাবেন তা থেকে খরচ করে কিছু ডলার সাশ্রয় করে দেশেও আনতে পারবেন। প্রশিক্ষণে যাওয়া কর্মকর্তাদের জন্য বাংলাদেশ সরকার ও অভ্যন্তরীণ তহবিলের কোনো টাকা বাইরে যাচ্ছে না। আমাদের কোনো ব্যয় নেই। পুরোটাই লাভ। তাই এই প্রশিক্ষণ কাজে আসবে, কি আসবে না সেই প্রশ্ন খুব বেশি গুরুত্ব বহন করে না।’
মন্ত্রণালয় সূত্র জানায়, গত ২৬ ফেব্রুয়ারি এ বিষয়ে মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয় থেকে একটি অফিস আদেশ জারি করা হয়। এতে বলা হয়েছে, ‘জলবায়ু স্থিতিস্থাপক অভিযোজন এবং মৎস্য ও জলজ খাতের ব্যবস্থাপনা পদ্ধতির প্রশিক্ষণ কর্মসূচিতে অংশ নিতে ২০ কর্মকর্তা ইন্দোনেশিয়া যাবেন।
১৩ থেকে ২৪ মার্চ পর্যন্ত কিংবা কাছাকাছি সময়ে তারা সেখানে অবস্থান করবেন। এই ২০ জনের মধ্যে তালিকার প্রথমেই থাকা মন্ত্রণালয়ের পাঁচ কর্মকর্তার মধ্যে আছেন মন্ত্রীর পিএস (যুগ্ম সচিব) আবু নাঈম মোহাম্মদ আব্দুস সবুর, সচিবের পিএস (উপসচিব) গোলাম মাইনুদ্দিন হাসান, যুগ্ম সচিব মোহাম্মদ হাবিবুর রহমান, উপসচিব মো. মোজাম্মেল হক ও মাহমুদা।
তালিকায় থাকা অন্য ১৫ জন হলেন ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলা মৎস্য কর্মকর্তা তাজমহল বেগম, মৎস্য অধিদপ্তরের সিনিয়র সহকারী পরিচালক শবনম মুস্তারি, বাগেরহাটের কচুয়া সিনিয়র উপজেলা মৎস্য কর্মকর্তা প্রণব কুমার বিশ্বাস, বাগেরহাট সদর উপজেলার সিনিয়র মৎস্য কর্মকর্তা ফেরদৌস আনসারী, মৎস্য অধিদপ্তরের প্রধান মৎস্য সম্প্রসারণ কর্মকর্তা জুয়েল শেখ, খুলনার ডুমুরিয়া উপজেলার সিনিয়র মৎস্য কর্মকর্তা আবুবকর সিদ্দিক, দাকোপ উপেজলার সিনিয়র মৎস্য কর্মকর্তা সেলিম সুলতান, মৎস্য অধিদপ্তরের সহকারী পরিচালক সালমা আক্তার, ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নাসির নগর উপজেলার সিনিয়র মৎস্য কর্মকর্তা শুভ্রা সরকার, মৎস্য অধিদপ্তরের সহকারী পরিচালক সমীর কুমার সরকার, সাতক্ষীরার শ্যামনগর উপজেলার সিনিয়র মৎস্য অফিসার তুষার মজুমদার, দক্ষিণ সুনামগঞ্জ উপজেলা মৎস্য কর্মকর্তা জাহিদুল ইসলাম, জগন্নাথপুর উপজেলা মৎস্য কর্মকর্তা মো. আখতারুজ্জামান, মৌলভীবাজারের জুরী উপজেলা মৎস্য কর্মকর্তা মো. মনিরুজ্জামান ও মৎস্য অধিদপ্তরের বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা মো. মাহফুজুর রহমান।
প্রশিক্ষণের তালিকায় থাকা মন্ত্রণালয়ের একজন দায়িত্বশীল কর্মকর্তা আলাপকালে নাম প্রকাশ না করার শর্তে প্রতিবেদককে বলেন, ফুড অ্যান্ড এগ্রিকালচার অর্গানাইজেশন (এফএও)-এর আয়োজনে এই প্রশিক্ষণ হবে। মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তাদের এই প্রশিক্ষণের অবশ্যই প্রয়োজন আছে।
কারণ মন্ত্রণালয়ের সহযোগিতা ছাড়া অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা কোনো কাজ এগিয়ে নিতে পারে না। তাই মন্ত্রণালয় ও মাঠপর্যায়ের কর্মকর্তাদের সমন্বয়ের কথা চিন্তা করেই তালিকা করা হয়েছে।
সংশ্লিষ্টরা বলেছেন, এ ধরনের প্রশিক্ষণ নিয়ে দেশে ফেরার পর কর্মকর্তাদের প্রশিক্ষণলব্ধ জ্ঞান মাঠপর্যায়ে কোনো কাজেই আসে না। প্রশিক্ষণ, সেমিনার এবং সিম্পোজিয়াম করা সরকারি কর্মকর্তাদের বিদেশ ভ্রমণের জন্য কৌশল মাত্র।
তাছাড়া জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে হাওড় ও সুন্দরবন এলাকায় মৎস্যচাষিদের কি ধরনের নেতিবাচক প্রভাব পড়বে তা জানতে মন্ত্রণালয় ও মৎস্য অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা যাবেন কেন? এদের পরিবর্তে হাওড় ও উপকূল অঞ্চলের মাঠপর্যায়ের মৎস্য কর্মকর্তারা এই প্রশিক্ষণ নিয়ে এলে কিছুটা হলেও তাদের অভিজ্ঞতা ও প্রশিক্ষণলব্ধ জ্ঞান ওই এলাকার মৎস্যচাষিদের জন্য কাজে লাগাতে পারতেন।
এ ধরনের প্রশিক্ষণের নামে মন্ত্রণালয় ও অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা মূলত ‘প্লেজার ট্রিপে’ যান। বিদেশে অবস্থানকালে তারা বৈদেশিক মুদ্রার অপচয় করে ভ্রমণ ও কেনাকাটায় আনন্দদায়ক সময় উপভোগ করেন।
জানতে চাইলে মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রী শ.ম. রেজাউল করিমের একান্ত সচিব আবু নাঈম মোহাম্মদ আব্দুস সবুর প্রশিক্ষণে যাবেন বলে স্বীকার করলেও এ বিষয়ে কোনো মন্তব্য করতে চাননি।