তত্ত্বাবধায়ক চিকিৎসকের মৃত্যু সহকর্মীরা গেলেন পিকনিকে!

মাসুক হৃদয় , ব্রাহ্মণবাড়িয়া
ব্রাহ্মণবাড়িয়া ২৫০ শয্যা বিশিষ্ট জেনারেল হাসপাতালের তত্ত্বাবধায়ক মোহাম্মদ ওয়াহীদুজ্জামান কর্মরত অবস্থায় মারা যাওয়ার পর শোকবার্তা প্রকাশ করেছে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর। কিন্তু মৃত্যুর ৪৮ ঘন্টা না পেরোতেই খোদ তার নিজ কর্মস্থলের ২৫ জন চিকিৎসক প্রমোদ ভ্রমণে যাওয়ায় ব্যাপক সমালোচনার সৃষ্টি হয়েছে।
জানা যায়, গতকাল মঙ্গলবার সকালে হাসপাতাল খোলার দিন ২৫ সদস্যের চিকিৎসক দল তাদের পরিবার পরিজন নিয়ে পিকনিকের উদ্দেশ্যে হবিগঞ্জের বাহুবল উপজেলার পুটিজুরি পাহাড়ে পাঁচতারকা মানের দ্য প্যালেস লাক্সারি রিসোর্ট যান। পরে বিকেলে আরো ১০ জন চিকিৎসক তাদের সঙ্গে অংশ নেন। সব মিলিয়ে তাদের পরিবার পরিজনসহ প্রায় ২ শতাধিক লোক পিকনিকে অংশ নেয় এবং সেখানে খাবার দাবার ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়।
হাসপাতালের একাধিক কর্মচারির মতে, গত ২০২১ সালের ২৩ জুন যোগদানের পর থেকে প্রায় আড়াই বছর ধরে এই তত্ত্বাবধায়ক তার অধীনস্থ সকল চিকিৎসককে নিয়মিত হাসপাতালে উপস্থিতির ব্যাপারে চাপ সৃষ্টি করতেন। কাজ পাগল তত্ত্বাবধায়কের কড়া নজরদারির কারণে অনেক চিকিৎসক সরকারি কর্মস্থলে সঠিক সময়ে হাজির হতে অনেকটা বাধ্য হতেন। এই কারণে উপপরিচালক পদমর্যাদার এই কর্মকর্তার উপর নাখোশ ছিলেন সরকারি চেম্বার ফেলে প্রাইভেট প্র্যাকটিসে অভ্যস্ত অনেক ফাঁকিবাজ চিকিৎসক।
তারা বলছেন, তত্ত্বাবধায়কের মৃত্যুতে অনেক চিকিৎসক যেন এই অবস্থা থেকে ‘মুক্তি’ পেয়েছেন। সেই মুক্তির আনন্দ উদযাপন করতে ওইসব চিকিৎসকেরা পাঁচ তারকা হোটেলে প্রমোদ ভ্রমণে গিয়েছেন।
কর্মচারিরা বলছেন, তত্ত্বাবধায়ক মোহাম্মদ ওয়াহীদুজ্জামানের সময়ে এই হাসপাতালে সেবার মান অতীতের সব রেকর্ড ছাড়িয়ে গেছে। তার সময়ে ওষুধ চুরিও কমেছে। হাসপাতালটির চিকিৎসাসেবায় আমূল পরিবর্তন এনেছেন তিনি।
হাসপাতালের প্রশাসন শাখা সূত্রে জানা গেছে, বিভিন্ন খাতে সরকারি রাজস্ব আয় বাড়ানোর পাশাপাশি সরকারি কোষাগারে নগদ অর্থ জমা করতে সক্ষম হয়েছে এই হাসপাতাল। সেবার মানের দিক দিয়েও গেল বছর (২০২৩) সারা দেশে প্রথম হয়েছে এই হাসপাতাল।
প্রতিষ্ঠার পর থেকে নানা সমস্যায় জর্জরিত এই হাসপাতালের বেশকিছু ইতিবাচক পরিবর্তন আনতে ভূমিকা রাখেন বিসিএস (স্বাস্থ্য) ক্যাডারের ২১ ব্যাচের এই কর্মকর্তা। হাসপাতালের চিকিৎসক, সেবিকাসহ সকল কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের যথা সময়ে কর্মস্থলে যোগদান এবং কর্মস্থল ত্যাগের ব্যাপারে এক প্রকার বাধ্য করতেন তিনি। একসময় হাসপাতালের প্যাথলজি বিভাগ সকাল আটটা থেকে বেলা দুইটা পর্যন্ত খোলা থাকলেও তিনি যোগদানের পর বৈকালিক সেবার পাশাপাশি রাত আটটা পর্যন্ত প্যাথলজি বিভাগ খোলা রাখতেন।
ইতিবাচক এসব কর্মকান্ডের সুফল সরাসরি সাধারণ মানুষ ভোগ করলেও খোদ সহকর্মী একদল চিকিৎসক এই কর্মকর্তার উপর বিরক্ত ছিলেন। হাসপাতালের দায়িত্ব বণ্টন ও দুই চিকিৎসকের বেতন বন্ধ করা নিয়ে তত্ত্বাবধায়কের সঙ্গে মতবিরোধ থেকে গেল বছরের ৩১ জুলাই হাসপাতালের একজন আবাসিক চিকিৎসক তাকে লাঞ্ছিত করার চেষ্টা করেন। ঘটনার জেরে প্রায় দেড় ঘণ্টা  চিকিৎসা সেবা বন্ধ ছিল। এই নিয়ে হাসপাতালে উত্তেজনাকর পরিস্থিতি তৈরি হলে পুলিশ গিয়ে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনে।
সেসময় তত্ত্বাবধায়ক এই প্রতিবেদককে জানিয়েছিলেন, সেদিন সকালে চক্ষু বিভাগের তিনজন চিকিৎসক তার কক্ষে এসে বলেন যে, তারা সপ্তাহে তিনদিন বহিঃবিভাগের রোগী দেখবেন এবং তিনদিন বৈকালিক সেবা দেবেন। এসময় তত্ত্বাবধায়ক তাদের বলেন, বহিঃবিভাগ বন্ধ থাকলে রোগীরা অসন্তোষ্ট হবে। ফলে বহিঃবিভাগ সপ্তাহের ছয় দিনই খোলা রাখা হোক, আর বৈকালিক সেবা প্রয়োজনে কম করা যেতে পারে। তখন তারা আগে যেভাবে চলছিল, সেভাবেই করবেন এবং তত্ত্বাবধায়কের কথা মানবেন না বলে জানান। তখন চক্ষু বিভাগের চিকিৎসক ওবায়দুল্লাহ উচ্চবাচ্য শুরু করলে তত্ত্বাবধায়ক তাকে ‘বেয়াদব’ বলেন। এই কথা বলার পর তত্বাবধায়কের দরজায় জোরে ধাক্কা দিয়ে বাইরে চলে যান ওই চিকিৎসক।

তত্ত্বাবধায়ক আরও জানিয়েছিলেন, “এর আগে, ২০২৩ সালের জুলাই মাসে আবাসিক চিকিৎসক রানা নূরুস শামস ও ফাইজুর রহমান নিয়মিত দায়িত্ব পালন না করায় তাদের বেতন বন্ধ রাখতে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে চিঠি দিয়েছেন। এই নিয়ে দুজন চিকিৎসক তার ওপর ক্ষুব্ধ ছিলেন। চক্ষু বিভাগের ওই চিকিৎসক ৩১ জুলাই ঘটনার পর  রানা নূরুস শামস ও ফাইজুর রহমানের কাছে যান৷ পরে রানা নূরুস শামস ও ওবায়দুল্লাহসহ তিনজন চিকিৎসক আবার তত্ত্বাবধায়কের কক্ষে আসেন। এসময় চিকিৎসক রানা নূরুস শামস তার সঙ্গে দুর্ব্যবহার করে লাঞ্ছিত করার চেষ্টা করেন এবং হুমকি দেন। পরবর্তীতে অন্যান্য চিকিৎসকরাও একসঙ্গে মিটিং করেন। পরে ওই চিকিৎসকেরা বাইরে থেকে সিসি ক্যামেরার লাইন বন্ধ করে আবার কক্ষে আসেন।

এসব বিষয় তিনি যথাযথ কর্তৃপক্ষকে চিঠি দিয়ে জানিয়েছেন বলেও এই প্রতিবেদকের কাছে তথ্য দেন। মূলত এসব কারণে তার ওপর বিরক্ত ছিল চিকিৎসকরা।

ব্রাহ্মণবাড়িয়া সচেতন নাগরিক কমিটির সভাপতি অ্যাডভোকেট আবদুন নূর বলেন, অফিস খোলার দিন পিকনিকে যাওয়ায় রোগীদের সেবা থেকে বঞ্চিত হওয়ার চেয়ে বেশি খারাপ লেগেছে একজন উর্দ্ধতন চিকিৎসকের মৃত্যুর রেশ না কাটতেই তারই সহকর্মী চিকিৎসকরা কিভাবে এ ধরণের আনন্দ ফুর্তির আয়োজন করতে পারলেন, সেটা ভেবে। চিকিৎসকের মতো মহান পেশাজীবীদের কাছ থেকে সাধারণ মানুষ এমনটা আশা করেন না। সহকর্মীর মৃত্যুর দুই দিনের মাথায় এ ধরণের আনন্দ আয়োজন নি:সন্দেহে অমানবিক। এ ব্যাপারে স্বাস্থ্য বিভাগের যথাযথ ব্যবস্থা নেওয়া উচিত।

তত্ত্বাবধায়কের মৃত্যুর পরে প্রমোদ ভ্রমণে যাওয়া প্রসঙ্গে বক্তব্য জানতে অন্তত চারজন চিকিৎসকের সঙ্গে যোগাযোগ করেন এই প্রতিবেদক। এদের মধ্যে একজন চিকিৎসক এই নিয়ে কিছু না লিখতে অনুরোধ করেন এবং বাকিরা কথা বলতে অপারগতা প্রকাশ করেন।

এ বিষয়ে হবিগঞ্জের দ্য প্যালেস লাক্সারি রিসোর্টের সুপারভাইজারের সঙ্গে মুঠোফোনে যোগাযোগ করা হলে তিনি ব্রাহ্মণবাড়িয়ার চিকিৎসকরা পিকনিকের জন্য এ রিসোর্ট বরাদ্দ নিয়েছেন বলে স্বীকার করেছেন। তিনি জানান, তিন বেলা খাবারসহ এই রিসোর্টে এক দিনের ভাড়া ২১ হাজার টাকা।

উল্লেখ্য, গত রোববার (১৮ ফেব্রুয়ারি) সকালে ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলা প্রশাসনের মাসিক উন্নয়ন সভায় যোগ দিতে সম্মেলন কক্ষে যান তিনি। সভা শেষে করে দুপুর সাড়ে ১২টার দিকে নিজ কর্মস্থলে ফিরে নাস্তা করার পর ডায়াবেটিসের মাত্রা বেড়ে গেলে অসুস্থ হয়ে পড়েন তিনি। পরে হাসপাতালের কয়েকজন চিকিৎসকসহ অন্যান্যরা তাকে দ্রুত ব্রাহ্মণবাড়িয়া আইসিইউ হসপিটালে নিয়ে যান।সেখানে চিকিৎসাধীন অবস্থায় বেলা পৌনে তিনটার দিকে তিনি শেষ নি:শ্বাস ত্যাগ করেন।
প্রয়াত মোহাম্মদ ওয়াহীদুজ্জামান কিশোরগঞ্জের কটিয়াদি উপজেলার আচমিতা ইউনিয়নের মধ্যপাড়া গ্রামের বাসিন্দা ছিলেন। ২০০৩ সালের ২১ মে তিনি স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের অধীনে সরকারি চাকুরিতে যোগদান করেন। ২০২১ সালের ২৩ জুন ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেনারেল হাসপাতালে তত্ত্বাবধায়ক হিসেবে যোগদানের পর মৃত্যুর পূর্বমুহুর্ত পর্যন্ত কর্মরত ছিলেন।
Post Under