এইচ.এম. সিরাজ, ব্রাহ্মণবাড়িয়া
করোনার সঙ্কটকালে জনপ্রতিনিধি, সাংবাদিক, রাজনৈতিক নেতারা সামনে থেকে দায়িত্ব পালন করলেও কেউই পায়নি কোনো সুরক্ষা সামগ্রী! অথচ উপজেলা প্রশাসন সুরক্ষা সামগ্রী কিনেছেন ১৩ লাখ টাকার! উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যানকে ম্যানেজে করেছেন খরচের বিল স্বাক্ষর। সুরক্ষা সামগ্রীর নামে ১৩ লাখ টাকা শ্রাদ্ধ হবার আলোচনা এখন সর্বমহলে। বিপুল অঙ্কের টাকার সামগ্রী কোথায় বিতরণ হলো, এমন অভিযোগ ইউএনওর বিরুদ্ধে। এহেন চিত্র ব্রাহ্মণবাড়িয়ার আখাউড়া উপজেলা প্রশাসনের।
অভিযোগ ওঠেছে, কেবল কাগজপত্রেই সুরক্ষা সামগ্রী বিতরণ করার হিসেব দেখিয়েছেন আখাউড়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা তাহমিনা আক্তার রেইনা। গত তিন মাসে করোনা সুরক্ষা সামগ্রী ক্রয় করা বাবদ এসব টাকা খরচ দেখিয়েছেন। অনিয়ম হয়েছে বুঝতে পেরেও উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান আবুল কাশেম ভুইয়া এসব বিলে স্বাক্ষর করছেন বলে স্বীকার করেছেন। তবে ইউএনও তাহমিনা আক্তার রেইনা’র দাবী, তিনি স্বচ্ছতার সাথেই এই টাকা খরচ করেছেন।করোনা ভাইরাসের সংক্রমণ রোধে উপজেলার বিভিন্ন ইউনিয়নে বিতরণের জন্যে চেয়ারম্যান এবং সাধারণ মানুষের মাঝে করোনা সুরক্ষা সামগ্রী বিতরণ করা হয়েছে বলে তিনি জানান।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, জেলার আখাউড়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা তাহমিনা আক্তার রেইনা করোনা ভাইরাসের সংক্রমণ রোধে উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সসহ সাধারণ মানুষের মাঝে সুরক্ষা সামগ্রী বিতরণ করেছেন। বিতরণ করা হয়েছে মাস্ক, পিপিই, হ্যাণ্ড সেনিটাইজারসহ ৩০ প্রকার সুরক্ষা সামগ্রী। এসব সুরক্ষা সামগ্রী ক্রয় বাবদ উপজেলা উন্নয়ন তহবিল থেকে উত্তোলন করা হয়েছে ১২ লাখ ৮৮ হাজার টাকা। এরমধ্যে দেড় লাখ টাকার পাঁচ হাজার মাস্ক, এক লাখ ৩৫ হাজার টাকার চার হাজার গ্লাভস, প্রায় ৮০ হাজার টাকার স্যানিটাইজার কেনা হয়েছে। প্রায় সাড়ে তিন লাখ টাকা ব্যয়ে উপজেলার বিভিন্ন স্থানে স্থাপন করা হয় ২৬টি বেসিন। তবে সরজমিনে গিয়ে ব্যবহার উপযোগী পাওয়া যায় ১৫ টি। বাকিগুলো নষ্ট হয়ে গেছে। কিন্তু এত বিপুল অঙ্কের টাকার সুরক্ষা সামগ্রী বিতরণের স্বচ্ছতা নিয়ে রাজনৈতিক মহলসহ সচেতন মানুষের মাঝে সৃষ্টি হয়েছে ধোঁয়াশা।
এসব বিষয়াসয় জানতে সাংবাদিকরা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার কাছে গেলে তিনি ‘সবকিছু নিয়ম মেনে করেছেন’ সাংবাদিকদের এমনটি জানিয়ে একটি ইস্টিমেটের কপি ধরিয়ে দেন। ইউএনও’র প্রদত্ত ইস্টিমেটে ১৭ টি আইটেমের উল্লেখ থাকলেও কোন্ আইটেম কত মূল্যে কেনা হয়েছে জানতে চাইলে তিনি কিছুই বলতে পারেন নি এবং কোনো বিল-ভাউচার দেখান নি। তিনদিন পর উপজেলা প্রকৌশলী অফিসের সার্ভের মো. জহুরুল ইসলামের মাধ্যমে ৩০ প্রকার সুরক্ষা সামগ্রী ক্রয়ের একটি তালিকা পাঠান। যার সাথে নেই ইস্টিমেটর কোনো মিল।এছাড়াও সাত হাজার ২২২জনকে ১৬ লাখ ৫০ হাজার টাকার শিশুখাদ্য এবং নগদ আর্থিক সহায়তা করেছেন। যার সঠিক কোনো হিসাব নেই ইউএনও’র কাছে। এদিকে আখাউড়ায় করোনা রোগী শনাক্তের আগেই ১৩ মার্চ ইস্টিমেট করা হয়। ইউএনও ১৫ মার্চ ওই ইস্টিমেটে স্বাক্ষর করেছেন। অথচ বাংলাদেশে ২৬ মার্চ থেকে লকডাউন ঘোষণা করা হয়। তখনও আখাউড়া উপজেলায় করোনা রোগী শনাক্ত হয়নি। ৯ এপ্রিল আখাউড়ায় প্রথম করোনার উপসর্গ চিহ্নিত হয়। করোনা শনাক্তের আগেই তিনি কিভাবে ইস্টিমেট করেন এই নিয়ে দেখা দিয়েছে সংশয়-প্রশ্ন আর সন্দেহ।
আখাউড়া উপজেলা যুবলীগের যুগ্ম আহবায়ক আবদুল মমিন বাবুল বলেন, ‘করোনাকালীন সময়ে যুবলীগের পক্ষ থেকে মাস্ক, হ্যাণ্ডস্যানিটাইজার বিতরণ করা হয়েছে। উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মাস্ক, হ্যাণ্ডস্যানিটাইজারসহ কোনোরূপ করোনা সামগ্রী বিতরণ করেছেন, এমনটি আমরা জানি না। তিনি কাকে কি দিয়েছেন? যুবলীগকেও দেননি একটি মাস্ক, হ্যাণ্ডস্যানিটাইজার। পৌর যুবলীগ সভাপতি মনির খান, উপজেলা ছাত্রলীগ সভাপতি শাহাবুদ্দিন বেগ শাপলুসহ একাধিক নেতা অভিযোগ করেন ইউএনওকে কোথাও এসব সামগ্রী বিতরণ করতে দেখিনি। তিনি আমাদেরকে কিছু দেননি। তাহলে তিনি ১৩ লাখ টাকার সামগ্রী কোথায়- কাকে দিলেন? নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক উপজেলা প্রশাসনের কয়েকজন কর্মকর্তা বলেন, ‘একই ভবনে থাকা সত্বেও আমরা কোনো সুরক্ষা সামগ্রী পাইনি।’ উপজেলা এলজিইডির সার্ভেয়ার জহুরুল ইসলাম বলেন, ‘এতো টাকার সুরক্ষা সামগ্রী দেওয়া হলো, অথচ কিছুই পাইনি।’ আখাউড়া দক্ষিণ ইউনিয়নের চেয়ারম্যান মো. জালাল উদ্দিন বলেন, ‘ইউএনও স্যার আমাকে ১০০ টি মাস্ক এবং ২০ জোরা গ্লাভস দিয়েছেন। এছাড়া আর অন্য কিছু পাইনি।’ আখাউড়া প্রেস ক্লাবের সভাপতি মো. রফিকুল ইসলাম বলেন,’করোনার ভাইরাসের দু:সময়ে সাংবাদিকরা জীবনের ঝুঁকি নিয়ে মাঠে থেকে সংবাদ সংগ্রহ করেছে। কিন্তু প্রশাসনের কাছ থেকে সাংবাদিকরা কোনো সুরক্ষা সামগ্রী পায়নি।’
আখাউড়া উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান আবুল কাসেম ভূইয়া বলেন, ‘আমি ৪/৫ লাখ টাকা খরচ করতে বলেছিলাম। কিন্তু ইউএনও নিজের ইচ্ছেমতো ১৩ লাখ টাকা খরচ করেছেন। বিল ভাউচার ঠিক না থাকায় প্রথমে আমি এই টাকা অনুমোদনে স্বাক্ষর করতেই রাজি ছিলাম না। পরে অনেকটা বাধ্য হয়েই স্বাক্ষর করেছি।’ আখাউড়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) তাহমিনা আক্তার রেইনা বলেন, ‘উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে মাস্ক, পিপিসহ অন্যান্য সামগ্রী দেওয়া হয়েছে। ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যানকে মাস্ক পিপি দিয়েছি। তাছাড়া বিভিন্ন স্থানে সাধারণ মানুষের মাঝে বিতরণ করেছি।’