দীর্ঘ ৫৪ বছরের প্রবীণ আইনজীবী। যিনি গরিবের আইনজীবী হিসেবে খ্যাত। সর্বজন শ্রদ্ধেয় এডভোকেট আব্দুল বাসেত মজুমদার। গতকাল সকাল ৮টায় রাজধানীর ইউনাইটেড হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মৃত্যুবরণ করেন (ইন্নালিল্লাহি…রাজিউন)। মৃত্যুর সময় তার বয়স হয়েছিল ৮৩ বছর। মৃত্যুকালে দুই ছেলে ও দুই মেয়েসহ অসংখ্য গুণগ্রাহী রেখে গেছেন। তার মৃত্যুতে শোক জানান প্রেসিডেন্ট, প্রধানমন্ত্রী, প্রধান বিচারপতি, স্পিকার, আইন মন্ত্রী, রেল মন্ত্রী, মৎস্য ও প্রাণিসম্পদমন্ত্রী, নৌ পরিবহনমন্ত্রী, দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের মেয়র এবং বিভিন্ন ব্যাক্তি, সংগঠন ও প্রতিষ্ঠান। প্রেসিডেন্ট আব্দুল হামিদ শোক বার্তায় বলেন, দেশে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা ও বিচার প্রার্থীদের আইনি সহায়তা দিতে আব্দুল বাসেত মজুমদারের অবদান চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবে।
আব্দুল বাসেত মজুমদারের মৃত্যু দেশের আইন অঙ্গনের জন্য এক অপূরণীয় ক্ষতি। তার মৃত্যুতে দেশ একজন দক্ষ আইনজীবীকে হারালো। রাষ্ট্রপতি প্রয়াত বাসেত মজুমদারের রুহের মাগফেরাত কামনা করেন এবং তার শোকসন্তপ্ত পরিবারের প্রতি গভীর সমবেদনা জানান।
প্রবীণ এই আইনজীবীর প্রথম জানাজা বেলা ১১টায় বনানী কেন্দ্রীয় মসজিদে অনুষ্ঠিত হয়। এরপর তার মরদেহ নিয়ে আসা হয় কর্মস্থল সুপ্রিম কোর্ট প্রাঙ্গণে। বাদ জোহর হাইকোর্ট প্রাঙ্গণে জানাজা হওয়ার কথা থাকলেও সেখানে স্থান সংকুলান না হওয়ায় জাতীয় ঈদগা ময়দানে জানাজার ব্যবস্থা করা হয়। দুপুর ২টায় জাতীয় ঈদগাহ ময়দান প্রাঙ্গণে তার দ্বিতীয় জানাজা অনুষ্ঠিত হয়। জানাজায় অংশ নিয়ে অশ্রুসিক্ত নয়নে তাকে শেষ বিদায় জানান হাজারো আইনজীবী। কফিনে রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রী, প্রধান বিচারপতি, স্পিকার, আইন মন্ত্রণালয়, অ্যাটর্নি জেনারেল কার্যালয়, সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতি, আওয়ামী লীগ, বঙ্গবন্ধু আওয়ামী আইনজীবী পরিষদ, বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী আইনজীবী ফোরাম কেন্দ্রীয় কমিটি, ল’ রিপোর্টার্স ফোরাম (এলআরএফ)সহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান ও সংগঠনের পক্ষ থেকে পুষ্পস্তবক অর্পণ করা হয়।
জুনিয়র আইনজীবীদের প্রিয় ব্যক্তি ছিলেন তিনি। এ দলমত নির্বিশেষে সবাই অংশ নেন জাতীয় ঈদগাহ মাঠের জানাজায়। আর কোনোদিন তার দেখা মিলবে না সুপ্রিম কোর্ট চত্বরে। সুপ্রিম কোর্ট প্রাঙ্গণে অনুষ্ঠিত জানাজায় উপস্থিত ছিলেন প্রধান বিচারপতি সৈয়দ মাহমুদ হোসেন, সুপ্রিম কোর্টের আপিল ও হাইকোর্ট বিভাগের বিচারপতিগণ, আইন, বিচার ও সংসদ বিষয়কমন্ত্রী আনিসুল হক, মৎস্য ও প্রাণীসম্পদ মন্ত্রী শ ম রেজাউল করিম, রেল যোগাযোগমন্ত্রী নূরুল ইসলাম সুজন, বিমান ও পর্যটনমন্ত্রী মাহাবুব আলী, অ্যাটর্নি জেনারেল এ এম আমিন উদ্দিন, সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির সম্পাদক ব্যারিস্টার রুহুল কুদ্দুস কাজল, ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের মেয়র ব্যারিস্টার শেখ ফজলে নূর তাপস, আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহবুবুল আলম হানিফ, সাবেক প্রতিমন্ত্রী জাহাঙ্গীর কবির নানক, যুবলীগের কেন্দ্রীয় কমিটির সাধারণ সম্পাদক মাইনুল হোসেন খান নিখিল, জাতীয়তাবাদী আইনজীবী ফোরামের কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য সচিব এডভোকেট মো. ফজলুর রহমান, বিএনপির যুগ্ম মহাসচিব ও সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির সাবেক সম্পাদক ব্যারিস্টার এ এম মাহবুব উদ্দিন খোকন, সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির সাবেক ও বর্তমান নেতৃবৃন্দ, আওয়ামী লীগের বিভিন্ন পর্যায়ের নেতৃবৃন্দ, বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতৃবৃন্দ।
জানাজার আগে সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির সম্পাদক ব্যারিস্টার মো. রুহুল কুদ্দুস কাজল আব্দুল বাসেত মজুমদারের বর্ণাঢ্য কর্মময় জীবনের বিভিন্ন দিক তুলে ধরেন। জানাজার আগে আব্দুল বাসেত মজুমদারের ছেলে আইনজীবী সাঈদ আহমেদ রাজা কান্নায় ভেঙে পড়েন। তিনি বলেন, বাবা ৫৪ বছর এ অঙ্গনে কাজ করেছেন। প্রতিদিন সকালে উঠে বলতেন, রাজা ওঠো, তাড়াতাড়ি কোর্টে যেতে হবে। আর কোনোদিন তিনি কোর্টে আসার কথা বলবেন না।
বাসেত মজুমদারের প্রতি কৃতজ্ঞতা জানিয়ে প্রধান বিচারপতি সৈয়দ মাহমুদ হোসেন বলেন, মিস্টার আব্দুল বাসেত মজুমদারের কাছে আমি চিরঋণী। এই ঋণ কোনোদিন শোধ করতে পারবো না। প্রধান বিচারপতি বলেন, আব্দুল বাসেত মজুমদার রাজনীতি নিয়ে ব্যস্ত থাকতেন। তাই তার সব সিভিল মামলা জুনিয়র হিসেবে হাইকোর্টে আমি করেছি। সুতরাং আব্দুল বাসেত মজুমদারের কাছে আমার যে ঋণ, সেই ঋণ কোনোদিন শোধ হবে না। আমি তার শোকসন্তপ্ত পরিবারের সদস্যদের প্রতি সমবেদনা জানাই। ওনার সব থেকে বড় পরিচয় ছিল উনি জুনিয়র আইনজীবীদের বন্ধু। জুনিয়ররা কত টাকা দিয়েছেন, তা হিসাব না করে তিনি সব মামলা করে দিয়েছেন। যখন যে আইনজীবী তাকে মামলা করতে বলেছেন, তিনি টাকার হিসাব না করে মামলা করে দিয়েছেন। অনেক গরিব মানুষের মামলা ফ্রি করে দিয়েছেন। আল্লাহ যেন তাকে জান্নাতবাসী করেন সেই প্রার্থনা করি।
গত ৩০শে সেপ্টেম্বর আব্দুল বাসেত মজুমদারকে ইউনাইটেড হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। শারীরিক অবস্থার অবনতি হলে সোমবার তাকে লাইফ সাপোর্টে নেয়া হয়। ফুসফুসের জটিলতায় ভুগছিলেন তিনি। বাসেত মজুমদার একাধিকবার বার কাউন্সিলের নেতৃত্ব দিয়েছেন। দায়িত্ব পালন করেছেন সুপ্রিম কোর্ট বারের সম্পাদক ও সভাপতি হিসেবে। দুস্থ আইনজীবীদের জন্য নিজের নামে ট্রাস্ট ফান্ড গঠন করেন তিনি। দেশের বিভিন্ন আইনজীবী সমিতিতে এই ফান্ড থেকে অর্থ সহায়তা দেয়া হয়। বঙ্গবন্ধু আইনজীবী পরিষদের সাবেক সভাপতি বাসেত মজুমদার নবগঠিত বঙ্গবন্ধু আওয়ামী আইনজীবী পরিষদের সম্মেলন প্রস্তুতি কমিটির যুগ্ম আহ্বায়ক পদে দায়িত্ব পালন করেন।
আইন পেশায় ৫৪ বছর ধরে নিয়োজিত ‘গরিবের আইনজীবী’ খ্যাত আব্দুল বাসেতের জন্ম ১৯৩৮ সালের ১লা জানুয়ারি। কুমিল্লার লাকসাম (লালমাই) উপজেলার শানিচোঁ গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন তিনি। তার বাবার নাম আব্দুল আজিজ মজুমদার, মা জোলেখা বিবি। স্থানীয় হরিচর হাইস্কুল থেকে ম্যাট্রিক (এসএসসি) এবং কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া কলেজ থেকে আইএ (এইচএসসি) ও বিএ পাস করেন বাসেত মজুমদার। তারপর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে মাস্টার্স ও এলএলবি ডিগ্রি অর্জন করেন। পরে ১৯৬৬ সালে হাইকোর্টে আইনজীবী হিসেবে তালিকাভুক্ত হন। জ্যেষ্ঠ এ আইনজীবীর বড় ছেলে গোলাম মহিউদ্দিন আব্দুল কাদের ব্যবসা করেন। ছোট ছেলে সাঈদ আহমেদ রাজা সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী।
দুই মেয়ের মধ্যে ফাতেমা আক্তার লুনা রবীন্দ্রসংগীত শিল্পী। সর্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সংগীতে পড়াশোনা করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপনা করছেন তিনি। ছোট মেয়ে খাদিজা আক্তার ঝুমা উত্তরা মেডিকেল কলেজের এসোসিয়েট প্রফেসর।
এদিকে, আবদুল বাসেত মজুমদারের মৃত্যুতে তার প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে সুপ্রিম কোর্টের আপিল ও হাইকোর্ট বিভাগের কার্যক্রম বন্ধ রাখা হয়। একইভাবে ঢাকার নিম্ন আদালতের বিচারিক কার্যক্রম বন্ধ ছিল। দুই দফা জানাজা শেষে তার মরদেহ পুরাতন বিমান বন্দরে নেয়া হয়। সেখান থেকে হেলিকপ্টারে করে লাশ কুমিল্লা আইনজীবী সমিতিতে নেয়া হয়। সেখানে তৃতীয় জানাজা শেষে তার লাশ গ্রামের বাড়িতে নেয়া হয়। গ্রামের বাড়িতে দু’দফা জানাজা শেষে পারিবারিক কবরস্থানে বাদ মাগরিব তাকে দাফন করা হয়। গ্রামের বাড়িতে বাসেত মজুমদারকে দেখার জন্য ঢল নামে মানুষের। অন্যান্যদের মাঝে উপস্থিত হয়ে পরিবারের সদস্যদের সমবেদনা জানান কুমিল্লা মহানগর আওয়ামীলীগের সভাপতি বীর মুক্তিযোদ্ধা আ ক ম বাহাউদ্দিন বাহার এমপি।