কলিংবেল চাপলেই ছুটে আসেন নবীনগরের এসি ল্যান্ড

নিজস্ব প্রতিবেদক:
সাধারণত সরকারি কর্মকর্তারা কোন দরকারি কাজে তার নিজ অফিস কক্ষে বসে কলিং বেল চাপেন। বেলের শব্দে বাইরে অপেক্ষমান অফিস সহকারি দৌড়ে আসেন কর্মকর্তার কক্ষে। বেশির ভাগ সরকারি অফিসেই এমনটি করা হয়। কিন্তু এর উল্টো চিত্র দেখা গেল ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নবীনগর উপজেলা ভূমি অফিসে। সেখানে সেবা গ্রহীতাদের জন্য রাখা হয়েছে কলিং বেল। সেবা পেতে কোনো সমস্যা হলে বেল চাপলেই স্বয়ং এসিল্যান্ড ছুটে যান সেবাগ্রহীতার কাছে এবং সমস্যা সমাধানের চেষ্টা করেন।

ভূমি অফিসে দালালের দৌরাত্ম্য, দিনের পর দিন হয়রানি, বাড়তি টাকা আদায়– এসব চিরচেনা নেতিবাচক ধারণা পাল্টে দিয়েছেন একজন সহকারী কমিশনার (ভূমি) মো. মোশারফ হোসাইন।

যোগদানের মাত্র ১০ মাসের মধ্যে সাড়ে সাত হাজার নামজারি ও ২০০ মিসকেস নিষ্পত্তি করে তাকে লাগিয়ে দিয়েছেন তিনি। যেখানে নিজের জমি খারিজ করতে সময় লাগবে ছয় মাস থেকে এক বছর সেই খারিজ সম্পূর্ণ করতে এখন সময় লাগে মাত্র ২৮ দিন।

নবীনগর উপজেলা ভূমি কার্যালয়ের চিরচেনা জটিলতা দূর করে দিয়েছেন এই এক কর্মকর্তা। এমনকি এই কার্যালয়কে জেলার মধ্যে সবচেয়ে ডিজিটাল ও আধুনিক করে গড়ে তুলেছেন তিনি। এজন্য চলতি বছর ভূমি সেবা সপ্তাহ-২০২২ উপলক্ষে আয়োজিত অনুষ্ঠানে তাকে জেলার শ্রেষ্ঠ সহকারী কমিশনারের সম্মাননা দেয়া হয়।

সম্প্রতি নবীনগর উপজেলা ভূমি কার্যালয়ে সরেজমিন গিয়ে দেখা যায়, পুরো কার্যালয় পরিপাটি করে সাজানো। ভবনের বাইরে টবে নানা প্রজাতির ফুল, ফল ও সৌন্দর্যবর্ধক গাছ। কার্যালয়ে প্রবেশের গেইটেই ‘আপনাকে উপজেলা ভূমি অফিসে স্বাগতম’ লেখা সাইনবোর্ড। এর দুই পাশ ফুলের গাছে আচ্ছাদিত। গেইটে প্রবেশ করে একটু সামনে এগুলেই চোখে পড়বে পুরো অফিসের ফ্লু চার্ট। এর পাশেই সাঁটানো সিটিজেন চার্টার। এতে জমির নামজারি করতে খরচ, খতিয়ান তোলার খরচ, খাসজমি বন্দোবস্ত নিতে করণীয়, কোন বিষয়ে কার সঙ্গে কীভাবে যোগাযোগ করতে হবে—এসব তথ্য লেখা রয়েছে।

এছাড়া অফিসের মূল ভবনের বাইরে রয়েছে নারী সেবা গ্রহীতাদের জন্য রিফ্রেশ কক্ষ- ‘অঙ্গনা’। এই কক্ষে নারীদের জন্য একটি ওয়াশরুম, নামাজের স্থানসহ একটি ব্রেস্টফিডিং কর্ণার রয়েছে। একটু সামনেই রয়েছে নবীনগরের ১৫টি ইউনিয়ন ভূমি কার্যালয়ের বিশালাকার ম্যাপ।

সহকারী কমিশনারের কক্ষের পাশেই রয়েছে নমুনা ফরমের বাক্স। বাক্সে থরে থরে সাজানো নানা আবেদন ফরম। সেখান থেকে সেবাপ্রার্থীরা বিনা খরচে ফরম নিতে পারেন। এছাড়াও সেবাগ্রহীতাদের জন্য রাখা হয়েছে অভিযোগ বাক্স। সেবা নিতে এসে কেউ হয়রানি হলে তারা সেখানে অভিযোগ করতে পারবেন।

সরেজমিন পরিদর্শনের সময় দেখা যায়, উপজেলা ভূমি অফিসের প্রতিটি কক্ষ নাম্বারিং করা এবং নেমপ্লেট লাগানো। নিচতলায় ১০৩ নম্বর কক্ষের পাশে সেবা গ্রহীতাদের জন্য রয়েছে বিশুদ্ধ পানির ব্যবস্থা। সিড়ির পাশে রয়েছে ফ্রন্ট ডেস্ক। সেখানে একজন কর্মচারী সেবাপ্রার্থীদের তথ্য সহায়তা দেন। তাছাড়া পুরো অফিসটি সিসি ক্যামেরা দ্বারা নিয়ন্ত্রিত।

এই অফিস ক্যাম্পাসের ভেতরেই রয়েছে ভূমি সেবা কেন্দ্র। এখানে সেবা গ্রহীতাদের বসার জন্য রয়েছে একটা গোলঘর। গোলঘরে রয়েছে একটি ‘সিটিজেন বেল’। কোনো সেবা গ্রহীতা যদি ভূমি অফিসের কোনো কর্মচারীর দ্বারা হয়রানির শিকার হন, তাহলে সেবাগ্রহীতা এখানে বেল চাপলেই স্বয়ং সহকারী কমিশনার (ভূমি) হাজির হবেন।

ভূমি অফিসের পেছনে স্থাপন করা হয়েছে শিশুদের জন্য বিনোদন কেন্দ্র ‘অবসর’। এখানে একটা দোলনা স্থাপন এবং বসার ব্যবস্থা করা হয়েছে। কার্যালয়ের পেছনে রয়েছে সেবাপ্রার্থীদের বিশ্রামের জায়গা। দূরদূরান্ত থেকে আসা লোকজন সেখানে বিশ্রাম নেন।

ভূমি অফিসের দোতলায় রয়েছে পরিপাটি রেকর্ড রুম। এমন আধুনিক রেকর্ড রুম অন্য কোন অফিসে চোখে পড়েনি। ইউনিয়ন ও মৌজা ভিত্তিক ভূমি সংক্রান্ত বিভিন্ন নথিপত্র লাল রংয়ের কাপড়ের ব্যাগে সাজানো রয়েছে। কোন একটি এলাকার নথির দরকার পড়লে খুব কম সময়ের মধ্যেই তা বের করা সম্ভব হয় বলে জানালেন রেকর্ড কিপার।

নবীনগরের বিটঘর গ্রাম থেকে ওই অফিসে সেবা নিতে এসেছিলেন বরকতের নেছা নামের এক বৃদ্ধা। মিসকেস এর বিষয়ে ওই অফিসের একজন কর্মচারীর সঙ্গে তাঁর কথা হয়। কিন্তু তিনি ওই কর্মচারীর কথায় সন্তুষ্ট না হয়ে সিটিজেন বেল-এ চাপ দেন। রিং বেজে উঠার পর পরই ওই বৃদ্ধার সামনে হাজির হন সহকারী কমিশনার মো. মোশারফ হোসাইন। বৃদ্ধার সাথে কথা বলে মিসকেসের আবেদন করার নমুনা ফরম তার হাতে তুলে দেন এবং সংযুক্ত কাগজপত্রাদির কথা তাকে বুঝিয়ে দেন।

কার্যালয়ে আসা সেবা গ্রহীতা আদম আলী মোল্লা জানান, তিনি জীবনে বহুবার এই কার্যালয়ে এসেছেন। কিন্তু এবার কার্যালয়ের অনেক পরিবর্তন নজরে পড়ে তাঁর। তাছাড়া এবার অফিসের আশেপাশে কোন দালালকেও খুঁজে পাওয়া যায়নি। এখন অতিরিক্ত টাকা দেওয়া ছাড়াই সরাসরি এসে সরকারি ফি জমা দিয়ে অনলাইনে আবেদন করে সঠিক সময়ে সেবা পাওয়া যাচ্ছে।

সহকারী কমিশনার মো. মোশারফ হোসাইন জানালেন, শুরুতেই পুরো অফিস ক্লোজ সার্কিট ক্যামেরার আওতায় এনে কঠোর মনিটরিংয়ের মাধ্যমে দালাল মুক্ত করা হয়েছে। অফিসের নবনির্মিত ভবনের সৌন্দর্যবর্ধনের জন্যেও নানা পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়েছে।

গত বছরের (২০২১) ২৬ জুলাই তিনি নবীনগর উপজেলা প্রশাসনের সহকারী কমিশনারের দায়িত্ব নেন। ৩৬ তম বিসিএস প্রশাসন ক্যাডারের এই কর্মকর্তার বাড়ি নরসিংদী সদর উপজেলার আলোকবালী ইউনিয়নের বাখরনগর গ্রামে। নবীনগরে যোগ দেওয়ার পর দেখেন, কার্যালয়ে দালালের দল। কাজের জন্য কেউ এলেই পড়তেন এদের খপ্পরে। বিনা মূল্যের ফরমে ৫০ থেকে ১০০ টাকা পর্যন্ত আদায় করতেন। এ অবস্থা দেখে তিনি চালু করলেন ‘সিটিজেন কলিংবেল’ সেবা।

তিনি বলেন, ‘যার কাজ তাকেই সরাসরি আমার অফিসে আসতে উৎসাহ দিচ্ছি। অন্য কারো হাত দিয়ে আসা মানেই সেখানে দালাল ঢুকে পড়া। ফলে এখন সেবা গ্রহীতারা সরাসরি আমার অফিসে আসতে পারছেন।’

এ বিষয়ে জানতে চাইলে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার জেলা প্রশাসক মো. শাহগীর আলম বলেন, সম্পূর্ণ নিজের উদ্যোগে এই অফিসকে বদলে দিয়েছেন নবীনগরের সহকারী কমিশনার। শুধু নবীনগর নয়, জেলার সবগুলো উপজেলার ভূমি অফিসগুলোকে এমন মডেল হিসেবে তৈরি করা হবে।

Post Under