ছিয়াত্তরের মন্বন্তর বাংলার ইতিহাসে সর্বাপেক্ষা ভয়াবহ দুর্ভিক্ষ নামে পরিচিত। তখন ছিল আঠারো শতকের চরম অর্থনৈতিক মন্দার বছর। ইস্ট ইন্ডিয়া কম্পানি খাজনা আদায়ের নামে সীমাহীন শোষণ আর লুণ্ঠন করে। পাশাপাশি সেই সময় (১৭৬৮-১৭৬৯) অনাবৃষ্টির কারণে ফসল উৎপাদন ব্যাহত হয়।
ফলে সৃষ্টি হয় ভয়াবহ দুর্ভিক্ষ। ১১৭৬ বঙ্গাব্দে (ইংরেজি ১৭৭০ সাল) এই দুর্ভিক্ষ হয় বলে একে ‘ছিয়াত্তরের মন্বন্তর’ বলা হয়।
১৭৫৭ সালে বাংলার শেষ স্বাধীন নবাব সিরাজউদ্দৌলা ষড়যন্ত্রের শিকার হয়ে ইংরেজদের কাছে পরাজিত হন। তখন থেকেই এ দেশে ব্যাপক সম্পদ লুণ্ঠন করতে থাকে ইংরেজরা। ১৭৬৫ সালে ইংরেজরা দিল্লির সম্রাট শাহ আলমের কাছ থেকে বাংলা-বিহার-ওড়িশার দেওয়ানি লাভ করে। বাংলার নবাবের হাতে থাকে নামে মাত্র প্রশাসনিক ক্ষমতা। রাজস্ব আদায় ও আয়-ব্যয়ের হিসাব থাকে ইস্ট ইন্ডিয়া কম্পানির কাছে। ফলে ইতিহাসে দ্বৈত শাসন নামে শাসনব্যবস্থার সৃষ্টি হয়। ক্ষমতাহীন নবাবের শাসনে ইস্ট ইন্ডিয়া কম্পানি খাজনা আদায়ের নামে সীমাহীন শোষণ আর লুণ্ঠন শুরু করে। ১৭৬৮ সালে আদায়কৃত রাজস্ব ১৫.২১ মিলিয়ন রুপির চেয়ে ১৭৭১ সালে আদায়কৃত রাজস্বের পরিমাণ পাঁচ লাখ ২২ হাজার রুপি বেশি ছিল। অথচ এর আগের বছরই ঘটে যায় দুর্ভিক্ষ। এই দুর্ভিক্ষে প্রায় এক কোটি মানুষ খাবারের অভাবে মারা যায়, যা সমগ্র বাংলার জনসংখ্যার এক-তৃতীয়াংশ। অতিরিক্ত রাজস্ব আদায় এবং খাদ্যশস্যের বাজারে বেশি মুনাফা অর্জন এই দুর্ভিক্ষের একটি বড় কারণ হলেও ইস্ট ইন্ডিয়া কম্পানি এটিকে প্রাকৃতিক বিপর্যয় বলে আখ্যায়িত করে।
ছিয়াত্তরের মন্বন্তরের ফলে বাংলার সামাজিক ও অর্থনৈতিক জীবন প্রচণ্ডভাবে বিপর্যস্ত হয়। কৃষক, তাঁতি, কামার, কুমোর প্রভৃতি শ্রমজীবী মানুষের ব্যাপক মৃত্যু ঘটার ফলে কৃষিকাজসহ বিভিন্ন পেশায় প্রকটভাবে লোকাভাব দেখা দেয়। বাংলার অনেক অঞ্চল হয়ে পড়ে জনশূন্য। সাহিত্য সম্রাট বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের ‘আনন্দমঠ’ উপন্যাস থেকে এই মন্বন্তরের ভয়াবহতার এক করুণ চিত্র পাওয়া যায়। (কার্টেসী: কালের কন্ঠ)