জিজ্ঞাসাবাদের মুখোমুখি ১১ র‌্যাব সদস্য

র‌্যাব হেফাজতে নওগাঁ ভূমি অফিসের কর্মচারী সুলতানা জেসমিনের (৩৮) মৃত্যুর ঘটনায় এক মেজরসহ বাহিনীর ১১ সদস্যকে দফায় দফায় জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে।

র‌্যাব সদর দপ্তরের তদন্ত কমিটি তাদের জিজ্ঞাসাবাদ করছে। এজন্য র‌্যাব-৫-এর জয়পুরহাট ক্যাম্প থেকে বৃহস্পতিবার তাদের রাজশাহী ব্যাটালিয়ন সদর দপ্তরে আনা হয়েছে। মামলার তদন্ত ও জিজ্ঞাসাবাদের পুরো প্রক্রিয়ায় কঠোর গোপনীয়তা বজায় রাখা হচ্ছে।

এদিকে এ ঘটনায় ফেঁসে যাচ্ছেন রাজশাহী বিভাগীয় কমিশনারের কার্যালয়ের পরিচালক (যুগ্মসচিব) এনামুল হক। তার বিরুদ্ধে তদন্ত ও বিভাগীয় ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে। জেসমিনের মৃত্যুর পর রাজশাহীর বিভাগীয় কমিশনার ব্যক্তিগত উদ্যোগে বিষয়টি তদন্ত করেন। এতে হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় এনামুল হকের বিতর্কিত ভূমিকার প্রমাণ মিলেছে বলে জানিয়েছে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের একাধিক সূত্র।

জেসমিনের মৃত্যুর ঘটনাটি র‌্যাব সদর দপ্তর তদন্ত করছে। তিন সদস্যের তদন্ত কমিটি এখন রাজশাহীতে অবস্থান করছে। তারা জেসমিনকে আটকের অভিযান পরিচালনায় অংশ নেওয়া র‌্যাব-৫-এর জয়পুরহাট ক্যাম্পের দলটিকে ডেকেছেন। মূলত এই দলটিকেই জিজ্ঞাসাবাদের জন্য মুখোমুখি করা হয়েছে।

র‌্যাব সূত্র বলছে, এ ঘটনায় কার কী ভূমিকা ছিল, সেটিই তারা নিরূপণ করছেন। যুগ্মসচিব এনামুল হক কীভাবে এই অভিযানের পেছনে ভূমিকা রেখেছেন, তাও জানার চেষ্টা করছেন তারা। অভিযানে অংশ নেওয়া র‌্যাব সদস্যরা তদন্ত কমিটিকে তথ্য দিয়ে সহযোগিতা করছেন বলে জানিয়েছেন র‌্যাব-৫ রাজশাহীর অধিনায়ক লেফটেন্যান্ট কর্নেল রিয়াজ শাহরিয়ার।

জানতে চাইলে র‌্যাবের আইন ও গণমাধ্যম শাখার পরিচালক কমান্ডার খন্দকার আল মঈন বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় যুগান্তরকে বলেন, অভিযানে অংশ নেওয়া র‌্যাব সদস্যদের জিজ্ঞাসাবাদের জন্য ডাকা হয়েছে। তদন্ত শেষ হলে তারা কর্মস্থলে ফিরে যাবেন। তারা বর্তমান পদেই বহাল থাকবেন।

যুগ্মসচিব এনামুল হকের মৌখিক অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে ২২ মার্চ সকালে নওগাঁর ভূমি অফিসের কর্মচারী জেসমিনকে আটক করে র‌্যাবের একটি দল। সেদিনই তাকে প্রথমে নওগাঁ এবং পরে রাজশাহীতে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। ২৪ মার্চ র‌্যাবের হেফাজতেই হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় জেসমিন মারা যান। পরিবারের অভিযোগ, নির্যাতন করে তাকে হত্যা করা হয়েছে।

বিষয়টি উচ্চ আদালত পর্যন্ত গড়িয়েছে। ঘটনার এ পর্যায়ে জানা যায়, যখন সুলতানা জেসমিনকে গ্রেফতার করা হয়, তখন তার বিরুদ্ধে কোনো মামলা ছিল না। এ বিষয়ে বৃহস্পতিবার সচিবালয়ে আইনমন্ত্রী আনিসুল হক সাংবাদিকদের বলেন, আমি পরিষ্কার বলতে পারি, ওই ভদ্রমহিলাকে যখন তুলে নেওয়া হয়, তখন তার বিরুদ্ধে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে কোনো মামলা ছিল না। ভদ্রমহিলার দুর্ভাগ্য অবশ্যই। তিনি যখন মারা যান, তখনও তার বিরুদ্ধে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে কোনো মামলা ছিল না।

ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে মামলা করা হয়েছে এর পরের দিন। এখানে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের অপব্যবহার করা হয়েছে। এ মামলায় প্রসিড করা হয়নি। আমার কথা হলো, এ আইন দিয়ে ওই নারীকে ধরা হয়নি। ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের অপব্যহার হচ্ছে কি না-প্রশ্ন করা হলে তিনি জানান, দু-একটি মামলায় এটি হচ্ছে। আমরা ব্যবস্থা নিচ্ছি। যেখানে আমরা দেখছি অপব্যবহার হচ্ছে, সেখানেই তা বন্ধে ব্যবস্থা নিচ্ছি।

মামলা তদন্তে কঠোর গোপনীয়তা : এদিকে জেসমিন সুলতানার (৪৮) বিরুদ্ধে রাজশাহীতে দায়ের হওয়া ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের মামলার বিষয়ে প্রাসঙ্গিক কোনো তথ্য দেওয়া হচ্ছে না। মামলার তদন্ত কর্মকর্তা আরএমপির রাজপাড়া থানার উপপরিদর্শক (এসআই) সুভাষ চন্দ্র বর্মণ মামলাটির তদন্তের বিষয়ে গণমাধ্যমকর্মীদের সঙ্গে কথা বলছেন না। রাজশাহী মহানগর পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারাও বিষয়টি এড়িয়ে চলছেন। ফলে মামলাটির প্রকৃত অবস্থা কী, তা নিয়ে সংশয় সৃষ্টি হয়েছে।

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, রাজশাহী বিভাগীয় কমিশনার অফিসের স্থানীয় সরকার বিভাগের পরিচালক যুগ্মসচিব এনামুল হক বাদী হয়ে ২৩ মার্চ রাতে রাজপাড়া থানায় ডিজিটাল আইনের ২০১৮-এর ২৪(২), ২৫(২), ২৬(২), ২৯(১) ও ৩৫ ধারায় মামলাটি করেন। মামলার দুই নম্বর আসামি র‌্যাব হেফাজতে মৃত সরকারি কর্মচারী জেসমিন সুলতানা।

অভিযোগে বলা হয়, ইলেকট্রনিক ডিভাইসের মাধ্যমে অন্যের রূপ নিয়ে, অনুমতি ছাড়া, তথ্য সংগ্রহ ও ব্যবহার করে মানহানি করেছে আসামিরা। ১৯ মার্চ সকাল ১০টা থেকে দুপুর ১২টার মধ্যে এই অপরাধ ঘটে। এর স্থান হিসাবে দেখানো হয়েছে রাজশাহী বিভাগীয় কমিশনার কার্যালয়ের সামনে। মামলার রেকর্ডিং অফিসার হিসাবে রাজপাড়া থানার অফিসার ইনচার্জ (ওসি) এএসএম সিদ্দিকুর রহমান ও পরিদর্শক (তদন্ত) রুহুল আমিনের নাম রয়েছে।

এদিকে যুগ্মসচিবের করা মামলায় প্রয়োজনীয় প্রামাণিক ডকুমেন্টস দেওয়া হয়েছে কি না, তা নিয়েও ধোঁয়াশার সৃষ্টি হয়েছে। মামলার তদন্ত কর্মকর্তা এসআই সুভাষ চন্দ্র বর্মণের কাছে বৃহস্পতিবার সকালে এ বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি কোনো তথ্য দিতে অপারগতা প্রকাশ করেন। ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেছেন কি না, তা বলতেও অসম্মতি জানান।

এসআই সুভাষ আরও বলেন, মামলার বিষয়ে বিশেষ কিছু জানতে হলে আরএমপির গণমাধ্যম শাখায় কথা বলতে হবে। কোনো ধরনের তথ্য না দেওয়ার বিষয়ে নির্দেশনা রয়েছে। শুধু এটুকুই বলতে পারি-মামলাটি গুরুত্ব দিয়ে তদন্ত হচ্ছে। আরএমপির এক কর্মকর্তা নাম গোপন রেখে বলেন, জেসমিনের কাছ থেকে জব্দ করা বিভিন্ন উপকরণ ও আলামত মামলার তদন্ত কর্মকর্তার কাছে হস্তান্তর করেছে র‌্যাব। তবে মামলার তদন্ত কর্মকর্তা এ বিষয়েও কোনো মন্তব্য করেননি।

তদন্তের অগ্রগতি সম্পর্কে জানতে চাইলে আরএমপির গণমাধ্যম শাখার দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা অতিরিক্ত উপকমিশনার (এডিসি) রফিকুল আলম বলেন, মামলাটি যথানিয়মে তদন্ত হচ্ছে। তদন্তে তাৎপর্যপূর্ণ অগ্রগতি হলে গণমাধ্যমকে জানানো হবে। মামলার প্রধান আসামি আল আমিনের গ্রেফতারের কোনো তথ্য নেই বলেও জানান তিনি।

এদিকে যুগ্মসচিব এনামুল হকের করা ডিজিটাল আইনের মামলায় পর্যাপ্ত তথ্য নিয়ে সংশয় আছে বিভিন্ন মহলের। এ বিষয়ে কথা হয় রাজশাহী বারের আইনজীবী হাবিবুর রহমান হাবিসুলের সঙ্গে। বৃহস্পতিবার দুপুরে তিনি যুগান্তরকে বলেন, যদি সামাজিক মাধ্যমে অপরাধ সংঘটিত হয়ে থাকে, সেক্ষেত্রে আনুষঙ্গিক তথ্য-প্রমাণাদি এজাহারের সঙ্গে অবশ্যই যুক্ত করতে হবে। এক্ষেত্রে তার স্ক্রিনশট, অডিও মাধ্যমে হলে অডিওভিজ্যুয়াল গ্যাজেট, ভিডিও মাধ্যমে হলে ভিডিও কনটেন্টের কথা উল্লেখ করেন তিনি।

এ আইনজীবী বলেন, বাদী মামলাটির ক্ষেত্রে সে ধরনের প্রামাণিক তথ্যাদি সংযুক্ত করেছেন কিনা-তা মামলার মূল এজাহারেই উল্লেখ থাকার কথা। ডিজিটাল যুগে অধিকাংশ সরকারি দপ্তর সিসিটিভি ক্যামেরার আওতায় থাকে। রাজশাহী বিভাগীয় কমিশনার অফিসের সামনে যেহেতু অপরাধ সংঘটনের কথা বলা হয়েছে; সেক্ষেত্রে সিসিটিভি ফুটেজেও আসামিদের অবস্থান ও অপরাধ কর্মকাণ্ড শনাক্ত হওয়ার কথা।

অন্যদিকে শুক্রবার রাজশাহীর সিনিয়র আইনজীবী আবুল হাসনাত বেগের নেতৃত্বে একদল আইনজীবী ঘটনাস্থল নওগাঁ যাবে বলে জানা গেছে। আইনজীবীরা জেসমিন সুলতানাকে তুলে নেওয়া থেকে শুরু করে পরবর্তী চার ঘণ্টায় তাকে কোথায় রাখা হয়েছিল, প্রত্যক্ষদর্শী এবং এই বিষয়ে জেসমিন সুলতানার স্বজন, অফিসের সহকর্মী ছাড়াও নওগাঁ সদর হাসপাতালের চিকিৎসকদের সঙ্গে সাক্ষাৎ করে কথা বলবেন। রাজশাহী ফিরে তারা ‘ফ্যাক্টস ফাইন্ডিং’ প্রতিবেদন প্রকাশ করবেন।

ফেঁসে যাচ্ছেন যুগ্মসচিব : র‌্যাব হেফাজতে সুলতানা জেসমিনের মৃত্যুর ঘটনায় ফেঁসে যাচ্ছেন রাজশাহী বিভাগীয় কমিশনারের কার্যালয়ের পরিচালক (যুগ্মসচিব) এনামুল হক। জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের নিয়োগ পদোন্নতি এবং প্রেষণ (এপিডি) অনুবিভাগের অতিরিক্ত সচিব মো. আব্দুস সবুর মণ্ডল যুগান্তরকে বলেন, রাজশাহীর বিভাগীয় কমিশনারের তদন্ত প্রতিবেদন আমরা হাতে পেয়েছি।

পরবর্তী কার্যক্রমের জন্য বিষয়টি বিবেচনায় রয়েছে। তদন্তে কি বেরিয়ে এসেছে জানতে চাইলে এপিডি বলেন, বিভাগীয় ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য আমাদের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। সার্ভিস রুলস অনুসারে পরবর্তী কার্যক্রম গ্রহণ করা হবে। আগে বিভাগীয় কার্যধারা শেষ হোক, তারপর বিস্তারিত জানতে পারবেন।

এদিকে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের শৃঙ্খলা ও তদন্ত অনুবিভাগের এক কর্মকর্তা যুগান্তরকে বলেন, এনামুল হকের বিরুদ্ধে বিভাগীয় মামলা হচ্ছে। অধিকতর তদন্তের জন্য তদন্ত কর্মকর্তা নিয়োগের প্রক্রিয়া চলছে।

একই অনুবিভাগের অপর এক কর্মকর্তা যুগান্তরকে বলেন, আগে তদন্ত হবে। তদন্তের পর তাকে কারণ দর্শানোর নোটিশ দেওয়া হবে। তারপর লিখিতভাবে জবাব দেবেন। সে আত্মপক্ষ সমর্থন ও ব্যক্তিগত শুনানির আবেদন করলে তখন তদন্ত কর্মকর্তা নিয়োগ করা হবে। তবে বিষয়টি যেহেতু স্পর্শকাতর, তাই কম সময়ের মধ্যে এনামুল হকের বিরুদ্ধে তদন্তের উদ্যোগ নেওয়া হবে।

নওগাঁয় মানববন্ধন : নওগাঁয় আটকের পর র‌্যাব হেফাজতে সুলতানা জেসমিন নামে ইউনিয়ন ভূমি অফিসের এক কর্মীর মৃত্যুর ঘটনায় সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ তদন্তের দাবিতে মানববন্ধন কর্মসূচি পালিত হয়েছে। আজ (বৃহস্পতিবার) সকাল সাড়ে ১০টার দিকে নওগাঁ শহরের মুক্তির মোড় এলাকায় সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন) নওগাঁ জেলা কমিটির আয়োজনে এ কর্মসূচি পালিত হয়।

Post Under