প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, বাঙালি জাতির প্রতিটি মহৎ, শুভ ও কল্যাণকর অর্জনে আওয়ামী লীগের ভূমিকা রয়েছে। আওয়ামী লীগ সরকারের নেতৃত্বে বাংলাদেশ আজ আত্মমর্যাদাশীল দেশ হিসেবে বিশ্বের বুকে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়েছি। আওয়ামী লীগের নেতৃত্বেই সমৃদ্ধির পথে এগিয়ে যাচ্ছে প্রিয় বাংলাদেশ।
আওয়ামী লীগের ৭১তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উপলক্ষে সোমবার দেয়া এক বাণীতে তিনি এ কথা বলেন। করোনার কারণে আজ মঙ্গলবার সাদামাটা কর্মসূচির মধ্য দিয়ে দলটির প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী পালন করা হবে।
আওয়ামী লীগ দল হিসেবেও মানুষের পাশে দাঁড়িয়ে সহযোগিতা করে যাচ্ছে উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘ভবিষ্যতেও আওয়ামী লীগ জনগণকে সঙ্গে নিয়ে জাতির পিতার স্বপ্নের ক্ষুধা-দারিদ্র্যমুক্ত, সুখী-সমৃদ্ধ, উন্নত ও আধুনিক সোনার বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠায় কাজ করবে।’
তিনি বলেন, ‘প্রাণঘাতী করোনাভাইরাস মোকাবেলায় আমরা প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিয়েছি। দেশের বিভিন্ন খাতে প্রায় ১ লাখ ১ হাজার ১১৭ কোটি টাকার ১৯টি প্রণোদনা প্যাকেজ ঘোষণা করা হয়েছে। করোনায় ক্ষতিগ্রস্ত ৫০ লাখ পরিবারকে এককালীন ২ হাজার ৫০০ টাকা করে অনুদান প্রদান করা হয়েছে।’ সম্প্রতি ২ হাজার ডাক্তার ও ৫ হাজার ৫৪ জন নার্সকে নিয়োগ দেয়াসহ আরও প্রায় ৩ হাজার নতুন পদ সৃষ্টি করা হয়েছে উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘জীবন ও জীবিকা রক্ষায় স্বাস্থ্যবিধি মেনে সীমিত আকারে প্রয়োজনীয় অফিস-আদালত- কলকারখানা চালু করা হয়েছে। সবাইকে স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলার নির্দেশনা দেয়া হয়েছে। কোভিড-১৯ মোকাবেলায় যে কোনো জরুরি চাহিদা মেটাতে ২০২০-২০২১ সালের অর্থবছরে ১ হাজার কোটি টাকার থোক বরাদ্দ দেয়া হয়েছে।’ শেখ হাসিনা বলেন, ‘এই দুর্যোগে কর্মহীন হয়ে পড়া মানুষকে নগদ অর্থ ও খাদ্য সহায়তা প্রদান করা হচ্ছে। সংকট উত্তরণে সব ধরনের সহযোগিতা করে যাবে সরকার। আওয়ামী লীগ দল হিসেবেও মানুষের পাশে দাঁড়িয়ে সহযোগিতা করে যাচ্ছে।’
আওয়ামী লীগের ৭১তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উপলক্ষে সংগঠনের অগণিত নেতাকর্মী, সমর্থক ও শুভানুধ্যায়ীসহ দেশবাসীকে আন্তরিক শুভেচ্ছা ও অভিনন্দন জানিয়ে তিনি শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করেন জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে। স্মরণ করেন আওয়ামী লীগের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী ও সাধারণ সম্পাদক সামসুল হকসহ অন্য নেতাদের। শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করেন হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী, জাতীয় চার নেতাসহ স্বাধিকার আন্দোলন, স্বাধীনতা সংগ্রাম ও গণতন্ত্রের সংগ্রামে শহীদ নেতাকর্মীদের।
শেখ হাসিনা বলেন, ‘বাঙালি জাতির মুক্তি ও অধিকার আদায়ের লক্ষ্যে ঢাকার কেএম দাস লেনের রোজ গার্ডেনে ১৯৪৯ সালের ২৩ জুন আওয়ামী লীগ প্রতিষ্ঠিত হয়। জেলে বন্দি থাকা অবস্থায় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সংগঠনের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন। প্রতিষ্ঠার পর থেকে এ ভূখণ্ডে প্রতিটি প্রাপ্তি ও অর্জন সবই আওয়ামী লীগের নেতৃত্বেই হয়েছে।’
প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘আওয়ামী লীগ এ দেশের মানুষের আত্মপরিচয়ের সংগ্রামের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত। ১৯৫২’র ভাষা আন্দোলন, ১৯৫৪’র যুক্তফ্রন্ট নির্বাচন, ১৯৬২’র আইয়ুবের সামরিক শাসনবিরোধী আন্দোলন, ১৯৬৪’র দাঙ্গার পর সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি প্রতিষ্ঠা, ১৯৬৬’র ছয় দফা আন্দোলন, ১৯৬৯’র গণঅভ্যুত্থানসহ সব আন্দোলন-সংগ্রাম পরিচালিত হয়েছে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে।’
তিনি বলেন, আওয়ামী লীগ এ দেশের মাটি ও মানুষের দল। আওয়ামী লীগই অর্জন করেছে মহান স্বাধীনতাসংগ্রাম ও মুক্তিযুদ্ধসহ সব গণতান্ত্রিক এবং মানুষের ভাত ও ভোটের অধিকার প্রতিষ্ঠার আন্দোলনে নেতৃত্বদানের সুমহান গৌরব। ১৯৭০’র নির্বাচনে বাঙালি জাতি আওয়ামী লীগের পক্ষে নিরঙ্কুশ রায় দেয়। যার ধারাবাহিকতায় ১৯৭১’র ৭ মার্চ ঢাকার তৎকালীন রেসকোর্স ময়দানে জাতির পিতা ঘোষণা করেন, ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম’।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘১৯৭১ সালের ১০ এপ্রিল জনগণের ভোটে নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের সমন্বয়ে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের প্রথম সরকার গঠিত হয়। সেই সরকারের নেতৃত্বে পরিচালিত সফল মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে বাঙালি জাতি ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর চূড়ান্ত বিজয় অর্জন করে। প্রতিষ্ঠিত হয় বাঙালির হাজার বছরের লালিত স্বপ্নের ফসল- স্বাধীন ও সার্বভৌম বাংলাদেশ।’
তিনি বলেন, ‘সদ্যস্বাধীন, যুদ্ধবিধ্বস্ত বাংলাদেশকে যখন জাতির পিতা তার স্বপ্নের সোনার বাংলায় রূপান্তরের সংগ্রামে নিরন্তর পরিশ্রম করে যাচ্ছেন, তখনই ঘাতকরা তাকে সপরিবারে হত্যা করে। আওয়ামী লীগকে নেতৃত্বশূন্য করতে কারাগারে হত্যা করা হয় জাতীয় চার নেতাকে। জাতীয় ও আন্তর্জাতিক চক্রান্ত এবং স্বাধীনতাবিরোধী চক্র ও অবৈধ সেনাশাসকদের নির্যাতন আর নিপীড়নের মাধ্যমে ধ্বংস করার চেষ্টা করা হয় আওয়ামী লীগকে। কিন্তু কোনো অপচেষ্টা সফল হয়নি। আওয়ামী লীগের তৃণমূল নেতাকর্মী, সমর্থকরা জীবন দিয়ে সব প্রতিকূলতা, ষড়যন্ত্র মোকাবেলা করে দলকে টিকিয়ে রেখেছে, শক্তিশালী করেছে।’
শেখ হাসিনা বলেন, ‘গণতন্ত্র ও ভোটের অধিকার প্রতিষ্ঠায় দীর্ঘ আন্দোলন-সংগ্রামের পর ১৯৯৬ সালে জনগণের ভোটে আবারও রাষ্ট্রক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হয় আওয়ামী লীগ। ১৯৯৬ থেকে ২০০১ সাল পর্যন্ত আওয়ামী লীগ অত্যন্ত সফলভাবে রাষ্ট্র পরিচালনা করে। উন্নয়ন ও অগ্রগতির পথে ঘুরে দাঁড়ায় বাংলাদেশ। আওয়ামী লীগ সরকারই খাদ্য ঘাটতির দেশ বাংলাদেশকে খাদ্য উদ্বৃত্তের দেশে পরিণত করে। আওয়ামী লীগ সরকারের প্রচেষ্টায় মহান একুশে ফেব্রুয়ারি আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসের মর্যাদা পায়। ভারতের সঙ্গে গঙ্গার পানি চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। কারও মধ্যস্থতা ছাড়াই স্বাক্ষরিত হয় পার্বত্য শান্তি চুক্তি। আওয়ামী লীগের ওই পাঁচ বছরের শাসনামলে জাতীয় ইতিহাসের গৌরবোজ্জ্বল সময় হিসেবে চিহ্নিত হয়ে থাকবে।’
তিনি বলেন, ‘বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের অপশাসন, দমনপীড়নের বিরুদ্ধে আন্দোলন এবং অগণতান্ত্রিক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সব ষড়যন্ত্র মোকাবেলা করে আওয়ামী লীগ ২০০৮ সালে জাতীয় সংসদ নির্বাচনে পুনরায় বিজয় অর্জন করে। ২০০৯ সাল থেকে ধারাবাহিকভাবে সরকার গঠন করে দেশ ও জাতির কল্যাণে নিরলসভাবে কাজ করে যাচ্ছে আওয়ামী লীগ।’
গত সাড়ে ১১ বছরে আর্থসামাজিক ক্ষেত্রে বাংলাদেশ অভূতপূর্ব সাফল্য অর্জন করেছে উল্লেখ করে শেখ হাসিনা বলেন, ‘বাংলাদেশ স্বল্পোন্নত দেশের তালিকা থেকে উন্নয়নশীল দেশের কাতারে উন্নীত হওয়ার যোগ্যতা অর্জন করেছে। স্বাস্থ্যসেবা এখন মানুষের দোরগোড়ায়। মানুষ বিনামূল্যে ৩০ ধরনের ওষুধ পাচ্ছেন। শিশু ও মাতৃমৃত্যুর হার কমেছে। গড় আয়ু বেড়ে ৭৩ বছরে পৌঁছেছে। ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ে তোলা হয়েছে। দেশ খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন করেছে।’
প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘মাধ্যমিক পর্যায় পর্যন্ত শিক্ষার্থীদের মধ্যে বিনামূল্যে পাঠ্যপুস্তক বিতরণ করা হচ্ছে। সাক্ষরতার হার ৭৩ ভাগের উপরে উন্নীত হয়েছে। ৯৬ ভাগ মানুষ বিদ্যুৎ সুবিধা পাচ্ছে। নারী শিক্ষার ব্যাপক প্রসার ঘটেছে। হয়েছে নারীর ক্ষমতায়ন। আমরা মাদ্রাসা শিক্ষা আধুনিক ও কর্মমুখী করেছি। বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট-১ উৎক্ষেপণ করে মহাকাশ বিজয় করেছে বাংলাদেশ। ১০০টি অর্থনৈতিক অঞ্চল, ২৮টির অধিক হাই-টেক পার্ক, বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট-২, গভীর সমুদ্রবন্দর, পদ্মা সেতু, এলএনজি টার্মিনাল, এক্সপ্রেসওয়ে, পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রসহ বিভিন্ন মেগা প্রকল্প বাস্তবায়ন করা হচ্ছে।’
শেখ হাসিনা বলেন, ‘আমরা ভারতের সঙ্গে স্থলসীমানা সমস্যার শান্তিপূর্ণ সমাধান করেছি। মিয়ানমার ও ভারতের সঙ্গে সমুদ্রসীমার শান্তিপূর্ণ সমাধান করেছি। আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে বিশ্বশান্তি প্রতিষ্ঠায় বাংলাদেশ প্রশংসনীয় ভূমিকা পালন করছে।’ প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘আমরা ২০২০ সালের ১৭ মার্চ থেকে বছরব্যাপী জাতির পিতার জন্মশতবার্ষিকী মুজিববর্ষ উদযাপনের সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম। কিন্তু করোনার কারণে আমরা মুজিববর্ষের উদ্বোধন অনুষ্ঠানে জনসমাগম না করে টেলিভিশনের মাধ্যমে সম্প্রচার করেছি। তবে মুজিববর্ষে গৃহহীনদের ঘর করে দেয়া হবে। এদেশে কেউ গরিব, গৃহহীন থাকবে না।’
তিনি আরও বলেন, ‘২০২১ সালের মধ্যে বাংলাদেশকে একটি মধ্যম আয়ের দেশ এবং ২০৪১ সালের আগেই উন্নত দেশে পরিণত করব।’
বাণীতে প্রধানমন্ত্রী স্বাস্থ্যবিধি মেনে, গণজমায়েত না করে ডিজিটাল পদ্ধতিতে আওয়ামী লীগের প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর কর্মসূচি পালন করার জন্য নেতাকর্মীদের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন।সূত্র-বাসস