করোনাভাইরাসের প্রকোপ না কমলে এবং এবার এইচএসসি পরীক্ষা নেওয়া সম্ভব না হলে বিকল্প মূল্যায়ন কী হতে পারে, সেই প্রস্তাব তৈরির নির্দেশ দিয়েছেন মাননীয় শিক্ষামন্ত্রী ডা. দীপু মনি। বৃহস্পতিবার (২৭ আগস্ট) এ সংক্রান্ত একটি খবর সংবাদমাধ্যমগুলোয় এসেছে।
সাধারণত প্রতিবছর এপ্রিলের শুরুতে এইচএসসি ও সমমানের পরীক্ষায় বসে উচ্চ মাধ্যমিক শ্রেণীর শিক্ষার্থীরা।এই পরীক্ষায় অংশগ্রহণকারী পরীক্ষার্থীর সংখ্যাটাও নেহায়েত কম নয়, এই বছর এই সংখ্যা যেমন প্রায় ১৩ লাখ। রেওয়াজ অনুযায়ী পরীক্ষা শেষের মাস দুয়েক পর অর্থাৎ আগস্টে ফলাফল পেয়ে যায় শিক্ষার্থীরা। ফলাফল পাওয়াতেই কিন্তু শেষ নয় এই পরীক্ষার রেশ। এসএসসি এবং এইচএসসি- এই দুই পাবলিক পরীক্ষা বাংলাদেশের অন্যান্য পাবলিক পরীক্ষা থেকে বহুলাংশেই গুরুত্বপূর্ণ। এজন্য দেশের অন্য দুই পাবলিক পরীক্ষা (পিইসি এবং জেএসসি) এই বছরের জন্য বাতিল করা গেলেও এইচএসসির ক্ষেত্রে সে রকম সিদ্ধান্ত নেয়া যাচ্ছে না। (এসএসসি পরীক্ষা করোনার প্রকোপের আগেই সম্পন্ন হয়েছে।) তার কারণ এইচএসসির ফলাফলের ভিত্তিতে বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষায় অংশ নেয়া না নেয়া নির্ভরশীল। একাদশ শ্রেণীতে ভর্তির প্রক্রিয়াটি ঘরে বসেই অনলাইনে সম্পন্ন করায় কিছুটা দুশ্চিন্তামুক্ত রয়েছেন অভিভাবকেরা। এই মুহূর্তে এইচএসসির শিক্ষার্থীরাই সবচেয়ে দুশ্চিন্তায় দিন কাটাচ্ছেন। জীবনের অন্যতম বড় এই পরীক্ষার উপর যে তাদের ভবিষ্যত শিক্ষা পরিকল্পনা নির্ভর করছে! প্রশ্ন হচ্ছে, কবে হবে এই পরীক্ষা?
অক্টোবরের ৩ তারিখ পর্যন্ত দেশের সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধের ঘোষণা এসেছে বৃহস্পতিবার। সেক্ষেত্রে এইচএসসিও ততদিন পর্যন্ত হবে না ধরে নেয়াই যায়। তাহলে এই বছর আর মাস বাকি থাকে তিনটি। অক্টোবর নাগাদ করোনার প্রকোপ যদি কমে যায় এবং কলেজ খুলে দেয়ার মত পরিস্হতি সৃষ্টি হয় সেক্ষেত্রে পরীক্ষাটা নিয়ে নেয়াই সবচেয়ে বড় সমাধান হওয়া উচিত। একজন শিক্ষার্থীর মেধার মূল্যায়ন পরীক্ষা দিয়েই সম্ভব। অন্য কোনো উপায়ে মেধার সঠিক মূল্যায়ন বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে সম্ভব কি না সেটি নিয়ে প্রশ্ন থেকে যায়। এই পরীক্ষার ফল দিয়েই বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে একজন শিক্ষার্থী ভর্তির আবেদনের যোগ্যতা বিবেচিত হয়, কোনো কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষায় এইচএসসির ফলাফলও গণনা করা হয়। তাই সম্ভাব্য সেরা সমাধান হতে পারে পরীক্ষা নিয়ে নেয়া। কিন্তু পরিস্থিতি অনুকূলে না থাকলে কিংবা পরীক্ষা নেয়া সম্ভব না হলে বিকল্প কি উপায় বেছে নেয়া যেতে পারে সেটি নিয়ে প্রস্তাব তৈরি করতে ঢাকা শিক্ষা বোর্ড, মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা অধিদপ্তর (মাউশি) এবং জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ডের কর্মকর্তাদের নির্দেশ দিয়েছেন মাননীয় শিক্ষামন্ত্রী। এক্ষেত্রে বিকল্প উপায় কি হতে পারে সেটি নিয়ে বিশেষজ্ঞরা ভাববেন। তবে বিকল্প ভাবনায় কিছু বিষ মাথায় রাখা জরুরি।
পরীক্ষা না নেয়া হলে বিকল্প সমাধান হিসেবে বিবেচনায় আসতে পারে নির্বাচনী পরীক্ষার ফলাফল মূল্যায়ন। সাধারণত নভেম্বরে এই পরীক্ষাটি হয়। পুরো সিলেবাসের উপর নেয়া এই পরীক্ষাটি গুরুত্বপূর্ণ হলেও বেশিরভাগ শিক্ষার্থীই তেমন গুরুত্ব দিতে চান না। অন্তত আমার অভিজ্ঞতা তাই বলে। যেহেতু এই পরীক্ষায় উত্তীর্ণ না হলে এইচএসসিতে বসার সুযোগ মেলে না, তাই শিক্ষার্থীদের সব আয়োজন সেই উত্তীর্ণ হওয়ার প্রস্তুতিতেই আবদ্ধ থাকে। নিজ নিজ কলেজে নেয়া এই পরীক্ষাটি প্রশ্নপত্র প্রণয়ন এবং উত্তরপত্র মূল্যায়নেও মেধার নিরপেক্ষ মূল্যায়ন হয় কি না সন্দেহের অবকাশ আছে। তাই এই পরীক্ষার ফলাফলকে বিকল্প ভাবা প্রশ্নের মুখে ফেলতে পারে।
আর বাকি থাকে অনলাইনে পরীক্ষা নেয়ার বিষয়টি। অন্যান্য দেশে বহুল ব্যবহ্রত হচ্ছে এই পদ্ধতিটি। তবে বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে সেটা কতটা কাজে দেবে সেটা নিয়ে ভাবার সুযোগ রয়েছে। করোনার লকডাউনের সময়ে বিভিন্ন মেধাভিত্তিক কুইজ অনলাইনে নেয়া হচ্ছে, সেখানে শর্ত দিয়ে দেয়া হচ্ছে একটির বেশি ব্রাউজার বা এক ব্রাউজারের অন্য উইন্ডো না ব্যবহারের। সেক্ষেত্রে বাতিল হবে পরীক্ষা। কিন্তু যাদের বাসায় একাধিক স্মার্টফোন বা ল্যাপটপ কম্পিউটার আছে তারা ঠিকই সুবিধা নিচ্ছে। সুযোগের ব্যবহার করে কে না এগিয়ে থাকতে চায়! মেধার মূল্যায়ন আর যাই হোক এই পদ্ধতিতে সম্ভব নয়। বাংলাদেশে বেশ কিছু স্কুল অর্ধবার্ষিক পরীক্ষা অনলাইনে নেয়ার উদ্যোগ নিয়েছিল। এজন্য পরীক্ষার ফি আদায় করে উত্তরপত্র বাসায় নিয়ে যেতে দিয়েছিল স্কুল কর্তৃপক্ষ। কথা ছিল পরীক্ষার দিন অনলাইনে প্রশ্নপত্র দেয়া হবে, পরীক্ষা দিয়ে সব বিষয়ের খাতা একদিন স্কুলে গিয়ে জমা দিয়ে আসবে। বাসায় বসে প্রশ্ন, উত্তরপত্র, বই-গাইড-নোটখাতা সামনে রেখে পরীক্ষা নেয়ার এমন পদ্ধতিতে বাণিজ্যিক উদ্দেশ্য হাসিল হলেও মেধার মূল্যায়ন তো হচ্ছেই না বরং শিক্ষার্থীদের নৈতিক শিক্ষায়ও আসছে নেতিবাচক প্রভাব৷ যে স্কুলগুলোর কথা বললাম তারা অবশ্য শেষ সময়ে এসে এভাবে পরীক্ষা নেয়ার সিদ্ধান্ত থেকে সরে এসেছে৷ এইচএসসির ক্ষেত্রেও এমন সিদ্ধান্ত নেয়ার আগে সংশ্লিষ্টদের ভাবনা চিন্তা করা উচিত।
আরো পড়ুনঃ
একইসাথে প্রস্তাব থাকবে, যে সিদ্ধান্ত নিয়েই আলোচনা হোক, সেটির চূড়ান্ত অনুমোদনের আগে শিক্ষা মন্ত্রণালয় ইউজিসি (বিশ্ববিদ্যালয় মন্জুরী কমিশন) বা বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর কর্তৃপক্ষের সাথে প্রাথমিক আলোচনা সেরে রাখা উচিত। এতে করে পরবর্তীতে বিশ্ববিদ্যালয় ভর্তি কার্যক্রমে জটিলতা এড়ানো যাবে। মোটকথা এইচএসসি পরীক্ষার সাথে সংশ্লিষ্ট সকলকেই আলোচনার টেবিলে বসিয়ে সকলের মতামতের মূল্যায়ন করে একটি সিদ্ধান্তে আসা উচিত৷
এইচএসসি পরীক্ষার ফলের ভিত্তিতে শিক্ষার্থীদের পরবর্তী পর্যায়ের উচ্চ শিক্ষার পথ নির্ধারিত হয়। সে কারণে বিষয়টি খুবই গুরুত্বপূর্ণ এবং জটিল। তাই শিক্ষার্থী-অভিভাবক এবং সর্বোপরী সরকারও এই বিষয়টি নিয়ে চিন্তায় আছে।
শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের একজন কর্মকর্তার বরাত দিয়ে সংবাদমাধ্যমের খবরে বলা হয়েছে, “ পরীক্ষা নেওয়া না গেলে বিকল্প মূল্যায়ন পদ্ধতি তৈরির ক্ষেত্রে ভবিষ্যতের ওই বিষয়গুলোও বিবেচনায় রাখতে হবে।”
আমরা তাই আশা করতে পারি সরকারের পক্ষ থেকে শিক্ষার্থীদের সম্ভাব্য সকল বিষয় বিবেচনায় নিয়েই সঠিক এবং সময়োপযোগী একটি সিদ্ধান্ত আসবে পরীক্ষার্থীদের জন্য।
লেকক: তানভীর মাহতাব আবীর
শিক্ষার্থী, নোয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়।