আহসান হাবিব, চান্দিনা উপজেলা নির্বাচন কর্মকর্তা
প্রাথমিক আলাপচারিতাশেষে “ভোটার তালিকায় অন্তর্ভুক্ত হওয়া”র ব্যবস্থা করে দেবো বলে জানানোর পরপরই পাশে বসা বোনের ইশারায় উনি আমার দিকে একখানা পাঁচশত টাকার নোট বাড়িয়ে দিলেন। আমি খানিকটা কৌতুকের সুরে বললাম, “এত অল্প টাকায় চলবে!” ভদ্রলোক বিব্রত হচ্ছেন ধারণা করে পরক্ষণেই হেসে বললাম, “আপনার এই কাজটা করে দেওয়াই আমার দায়িত্ব। এর জন্যই মাসশেষে রাষ্ট্রীয় কোষাগার থেকে আমি মাইনে পাই।” জিজ্ঞাসা করলাম, “এই অফিসের কেউ আপনাদের কাছে কোন টাকা-পয়সা চেয়েছে?” জবাবে চায়নি বলে জানালেন। আশ্বস্ত হলাম।
মোবারক চাচার কথা বলছিলাম। মোঃ মোবারক হোসেন। বয়স ৬৪। এখনো ভোটার তালিকায় অন্তর্ভুক্ত হননি। নতুন নিবন্ধনের আবেদনটা যাচাই-বাছাই করে একটু খটকা লাগল। এতদিনেও ভোটার হননি কেন! কোভিড পরিস্থিতির কারণে খুব জরুরি না হলে রুমে লোকজন আসাকে নিরুৎসাহিত করি। যাচাই-বাছাইয়ের জন্য উনাকে ভিতরে ডাকতে বললাম।
সমাজবিধির পথ গেল খুলে,
আলাপ করলেম শুরু —
মোবারক চাচা একজন বীর, একজন মুক্তিযোদ্ধা। ১৫/১৬ বছর বয়সে মুক্তিকামী যোদ্ধার খাতায় নাম লিখিয়েছিলেন। মাসব্যাপী প্রশিক্ষণ নিয়েছিলেন “বাগমারা ট্রেনিং সেন্টার” নামে ভারতের কোন এক ক্যাম্পে। তারপর মেজর হায়দারের নেতৃত্বে অস্ত্র হাতে জীবন দেওয়া-নেওয়ার খেলায় লিপ্ত হন। যুদ্ধ করেন মুক্তিযুদ্ধের ২ নম্বর সেক্টরের অধীনে।
যুদ্ধশেষে আবার ফেরেন পড়াশোনায়। মুক্তিযুদ্ধে জয়ী হলেও জীবনযুদ্ধে বিজয়ী হতে পারেননি বীরযোদ্ধা মোবারক চাচা। তার ভাষ্যমতে, কষ্টেসৃষ্টে বিএ পরীক্ষা দিলেও পাশ জুটেনি। বৈমাত্রেয় ভাইদের ষড়যন্ত্র ও নির্যাতন বিষিয়ে তোলে তার জীবন। নানাবিধ মর্মযাতনায় ৪০/৪১ বছর বয়সে মানসিক ভারসাম্য হারান তিনি। দীর্ঘদিন ছিলেন নিখোঁজ। ১৮/১৯ বছর পর তাকে খুঁজে পান তার আপন বোন আমেনা বেগম। মানসিক হাসপাতালে ভর্তি করিয়ে চিকিৎসার ব্যবস্থা করান। খানিকটা সুস্থ হলে প্রায় ৬০ বছর বয়সে ভাইকে বিয়ে করান তিনি। এলাকার গণ্যমান্যদের সহায়তায় বৈমাত্রেয় ভাইদের সাথে লড়াই করে কোনমতে মাথা গোঁজার মত একটা ঘরের ব্যবস্থা হয়। পরিবারে জন্ম নেয় একটি সন্তানও।
জীবনযুদ্ধে নাস্তানাবুদ হওয়া মোবারক চাচার একমাত্র অবলম্বন “মুক্তিযোদ্ধা ভাতা”। জাতীয় পরিচয়পত্র না থাকায় সেটি পেতেও সমস্যা হতে পারে ভেবে শঙ্কিত মোবারক চাচা ও তার বোন আমেনা বেগম! তাই, শুরুতেই চোখের জলে ভেজানো আবেদন। আর কার্যোদ্ধারে খুশি হয়ে কিংবা পরবর্তী ধাপ নির্ঝঞ্ঝাট করতে অথবা নিয়মে পরিণত হওয়া অনিয়মের কাছে স্বেচ্ছা-সমর্পণের নিমিত্তে পাঁচশত টাকার “বখশিশ”।
চোখ ঝাপসা হয়ে আসে যেন! আন্তরিকভাবে দ্রুততার সাথে ওনার কাজটুকু করে দেওয়ার প্রয়াস চালালাম। শেষে জানালাম, “আপনাদের মত মোবারক চাচাদের আত্মত্যাগী সাহসিকতার জন্যই তো আমার চেয়ার! শত সহস্র বিস্মৃত বলিদানেই তো আজকের স্বাধীন স্বদেশ, প্রিয়তম বাংলাদেশ!”
সবশেষে, মোবারক চাচার হাসিমুখ। নানা প্রাপ্তি-অপ্রাপ্তির ভিড়ে একজন সরকারি চাকুরের এই তো পরম পাওয়া! আহা, এ যে পরমানন্দ!