ক্ষমতা যেখানে, বিপদও সেখানেই 

এইচ.এম. সিরাজ
মানুষ। এই ভ্রমাণ্ডে মহান স্রষ্টার সকল সৃষ্টিকুলের শ্রেষ্ঠ জীব। পবিত্র কোরআনে যাকে বলা হয়েছে ‘আশরাফুল মাখলুকাত’। আবার মানুষই জগতের সবচে’ লোভাতুর প্রাণীও বটে। মানুষের ধ্বংসেরও অন্যতম একটি কারণ হচ্ছে লোভ। যেনো উৎকৃষ্টের মাঝে নিকৃষ্ট তথা শ্রেষ্ঠ’র মাঝে ভ্রষ্ট’র বসবাস! লোভের বশবর্তী হয়েই আমরা ক্রমান্বয়ে এমন কিছুতে হই মত্ত, যা আপাতদৃষ্টে ভালো মনে হলেও এর পরিণাম হয়ে ওঠতে পারে ভয়ানক, তা ভুলে যাই বেমালুম। লোভ-লালসা চরিতার্থের আরেক উপকরণ ‘ক্ষমতা’। এই ক্ষমতার মোহে অন্ধ হওয়া, স্বার্থ চরিতার্থে ক্ষমতাবানের সাহচর্য হাসিলে প্রচেষ্টা, মানুষের সহজাত প্রবৃত্তিও বটে। অথচ ‘যেখানেই ক্ষমতা আছে, সেখানে বিপদও আছে’ কথাটি কি ক্ষমতার পিছু হন্যে হয়ে দৌড়াতে থাকা মানুষেরা কদ্যপিও মনে রাখেন? নাকি রাখতে চান ?
ভারতীয় উপমহাদেশে মোঘল সাম্রাজ্যের তৃতীয় সম্রাট ছিলেন জালাল উদ্দিন মোহাম্মদ আকবর। সর্বধর্মের মানুষের প্রিয়ভাজন হবার কারণেই ইতিহাসে ‘মহামতি আকবর’, ‘আকবর দ্যা গ্রেট’ নামেও সমধিকতর খ্যাত। প্রবল পরাক্রমশালীতার জন্য আজ অবধি মানুষের কাছে নন্দিত। তাঁর সভাসদে ‘নবরত্ন’র খ্যাতি বিশ্বজুড়ে। কারোর ব্যক্তিত্ব ও ‘ঠাটবাট’ বুঝাতে মানুষের মুখে মুখে ‘তুমি কি নিজেকে সম্রাট আকবর মনে করো?’ কথাটি আজও তুমুল প্রচলিত। সম্রাট আকবর তখন ফতেহপুর সিক্রিতে থাকতেন।তাঁর কাছে আগত অতিথিদের জন্যে আয়োজন করেন একটি অনুষ্ঠানের। তানসেনকে ডেকে সম্রাট বললেন, ‘আপনার গানের সাথে কিন্তু অনুষ্ঠানে কাউকে নাচতেও হবে।’ তানসেন বললেন,’আচ্ছা। আমি চেষ্টা করবো নর্তকী রাখতে, কিন্তু আমি তো এখানকার কোনো নর্তকীকে চিনিনা। দাসীদের মধ্য থেকেই কেউ একজন সম্রাট ও তানসেনের মধ্যকার আলাপচারিতা শুনেছিলেন। সম্রাট চলে গেলে ওই দাসী তানসেনের নিকট জরিনা নামের একজন নর্তকীর কথা বললেন। তানসেন যেনো জরিনাকে অনুষ্ঠানে নাচার জন্য প্রস্তাব দেয়, এমন পরামর্শ প্রদান করলেন।
তানসেনের মতো বিখ্যাত গায়ক যখন নর্তকী জরিনাকে সম্রাট আকবরের প্রাসাদে আয়োজিত অনুষ্ঠানে নাচার জন্য প্রস্তাব দিলেন, তখন জরিনার আধ্যাত্মিক সাধক বাবা আর না করতে পারলেন না। তানসেনের প্রস্তাব গ্রহণ করে জরিনা ফতেহপুর সিক্রিতে চলে আসবার সময় তার বাবার কাছে বিদায় নিতে যান। আধ্যাত্মিক সাধক বাবা সেদিন কন্যা জরিনাকে একটি পরামর্শ দিলেন– “একটা ব্যাপার মাথায় রাখবে, যেখানে ক্ষমতা আছে, সেখানে বিপদও আছে। সাবধানে থাকবে, আর এটি মনে রাখবে তোমার জন্য আমি সবসময়ই আছি।’ জরিনা ফতেহপুর সিক্রির প্রাসাদে গিয়ে সম্রাট আকবর এবং তাঁর সভাসদদের সামনে সারারাত ধরে নাচলেন। তবে এটাও সত্য যে, জরিনার কাছে সম্রাট আকবরের প্রাসাদে নাচা ছিলো ‘স্বপ্ন সত্যি’র ব্যাপার। অপরদিকে সম্রাট আকবর নাচ দেখে এতোটাই মুুুগ্ধ হলেন যে, তিনি জরিনাকে প্রাসাদে রেখে দিলেন যাতে প্রয়োজন হলেই তাকে ডাকতে পারেন।
ফতেহপুর সিক্রির প্রাসাদের সকলেই জরিনাকে পছন্দ করলেও রাণী যোধা বাঈ’র এক দাসী পছন্দ করেন নি। সম্রাটের কাছ থেকে নর্তকী জরিনা অধিক মনোযোগ পাবার কারণেই জরিনার প্রতি ঈর্ষাকাতর হয়ে ওঠেন রাণী যোধা বাঈ’র দাসী মাধবী।সম্রাট আকবরের চোখে জরিনাকে অপরাধী সাজাতে মাধবী একটা কূট বুদ্ধিও আঁটলেন। রাণী যোধা বাঈ স্নান করতে যাবার পরপরই রাণীর গয়নার বাক্স থেকে একটি সোনার বালা চুরি করে জরিনার জিনিসপত্রে লুকিয়ে রাখেন দাসী মাধবী। রাণী যোধা বাঈ স্নান সেরে তাঁর একটি বালা নেই দেখে মারাত্মক ক্রোধান্বিত হয়ে সারা প্রাসাদ তল্লাশির নির্দেশ দিলেন। মাধবী তখন রাণী যোধা বাঈকে বলেন, ‘আমি জরিনার ঘরে সেই বালাটি দেখেছি!’ অবশেষে জরিনার থাকার ঘরে বালাটি পাওয়া গেলে রাণী যোধা বাঈ রাগে ফেটে পড়লেন। সম্রাটের কাছে গিয়ে নালিশ জানিয়ে বললেন, ‘নর্তকী জরিনা একটা চোর। এই ব্যাপারে আপনি এখন কী করবেন?
রাণী যোধা বাঈ’র নালিশ বলে কথা। সম্রাট আকবর জরিনাকে দরবারে ডেকে পাঠান।জরিনা তখন সম্রাটের সামনে কাঁদতে কাঁদতে বললেন,’হুজুর, আমি বালা চুরি করিনি।’ সম্রাট তখন বললেন,- ‘তোমার ঘরে কিভাবে বালা পাওয়া গেলো, তুমি কি সেই ব্যাখ্যা দিতে পারবে?’ স্বাভাবিকভাবেই জবাবে জরিনার নিকট বলার মতন কোনোকিছুই ছিলো না। কারণ সে তো জানতোই না, রাণী যোধা বাঈ’র বালা কিভাবে তার ঘরে গেল! সম্রাট আকবর মাথা নেড়ে বললেন,-‘প্রমাণ যেহেতু দেখাই যাচ্ছে যে জরিনা চোর এবং মিথ্যুক, সেহেতু চুরি করার শাস্তি হিসেবে তার হাত কেটে দেওয়া হবে।’জরিনা তখন  অতিশয় কাতর কণ্ঠে বলেন,-‘হুজুর,আমি অতি সামান্য এক নর্তকী। আমার হাত কেটে ফেললে আমি নাচবো কীভাবে? তাছাড়া আমি তো চুরি করিনি।’ এই কথায় সম্রাট আকবর চিৎকার করে বললেন,- ‘একদম চুপ! আগামীকাল সকালে তোমাকে শাস্তি দেওয়াটাই হবে প্রথম কাজ।’ এই ঘোষণা দিয়েই সম্রাট আকবর দরবার কক্ষ ত্যাগ করলেন।
জরিনা এই ঘোষণা শোনার পর সারাটা দিন কাঁদলেন। আবার রাতে অন্যান্য দিনের মতোই সম্রাটের সামনে নাচলেন। কিন্তু সে নাচ ছিলো না আনন্দের, সেটি ছিলো খুবই ধীরগতির দু:খের নাচ। সভাসদদের কেউই এতো সুন্দর নাচ জীবনে দেখেনি। জরিনার নাচ আর দেখতে পারবেন না ভেবে সম্রাটও খুব দু:খ পেলেন। পরদিন সকালে আকবর সভাসদদের ডাকলেন এবং জরিনাকে নিয়ে আসার জন্য এক রক্ষীকে পাঠালেন। সারা প্রাসাদ তন্ন তন্ন করে খুঁজেও জরিনাকে পাওয়া গেলো না! রক্ষী ফিরে এসে এ কথা জানালে সম্রাট আকবর জিজ্ঞাসা করলেন, ‘কেউ কি জরিনাকে দেখেছে?’সভায় উপস্থিত সবাই একে অন্যের  মুখ চাওয়াচাওয়ি করতে থাকেন। তখনই একজন বৃদ্ধ প্রবেশ করেন সভায়। সিংহাসনে আরোহিত সম্রাটের সামনে গিয়ে সে বললেন,- ‘হুজুর, কোনো প্রমাণ ছাড়াই জরিনাকে অভিযুক্ত করে আপনি ভুল করেছেন।’ সম্রাট জরিনার বাবাকে চিনতে পেরে বললেন, ‘জরিনা এখন কোথায় আমাকে বলুন, তার সাথে যাতে ন্যায়বিচার হয় তা আমি দেখবো।’ বৃদ্ধ মাথা নেড়ে বলেন,-‘আপনি অনেকটাই দেরি করে ফেলেছেন।আর কোনোকিছু করা যাবে না। আপনি আমার মেয়ের জীবনে অনেক বেশি দু:খ এনে দিয়েছেন, ফতেহপুর সিক্রি অবশ্যই এ বেঈমানির শাস্তি পাবে। ‘বৃদ্ধের কথার অর্থ কী’ সম্রাট জিজ্ঞাসা করার আগেই বৃদ্ধ লোকটি ভিড়ে মিশে অদৃশ্য হয়ে গেলেন।
জরিনার হদিস আর মিললো না। এই ঘটনার দুই সপ্তাহ পর, ফতেহপুর সিক্রির সমস্ত কোয়াগুলি গিয়েছিলো শুকিয়ে। সম্রাট আকবরের উট, ঘোড়া এমনকি মানুষের জন্যও কোনো পানিই আর অবশিষ্ট ছিলোনা ফতেহপুর সিক্রির কোয়াগুলোয়। এই ঘটনার পর সম্রাট আকবর তার স্ত্রীদের এবং সন্তানদের নিয়ে ফতেহপুর ছেড়ে সেই যে আগ্রার দুর্গে গিয়ে উঠলেন, আর কখনো ফতেহপুরে ফিরে আসেননি।ফতেহপুর সিক্রি গ্রামে এই গল্প এখনো প্রচলিত আছে। গ্রামের কেউ কেউ বলে থাকেন,’ভরা পূর্ণিমার রাতে ফতেহপুর সিক্রির প্রধান ফটকে, বুলন্দ দরজাতে যেনো কাউকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখা যায়! এবং এটা আসলে মাধবী। সে জরিনার জন্যই অপেক্ষা করে, যাতে তার কাছে ক্ষমা চাইতে পারে।’
জরিনাকে আর কেউ কোত্থাও না দেখলেও ইতিহাস ঠিকই তাকে দেখে-ধরে রেখেছে। যুগের পরিক্রমায় এমনি বহু জরিনা কাল-মহাকালের সাক্ষী হয়েই থাকেন, যেনো আমরা ইতিহাস থেকে সঠিক শিক্ষা গ্রহণে হই সচেষ্ট। কিন্তু বাস্তবতায়!
             ‘রাজায় করিছে রাজ্য শাসন,
                রাজাকে শাসিছেন রাণী।’
প্রবাদটি আজ অবধি চিরন্তন। আজকাল অবশ্য রাজা বাদশাহ্ কিংবা সম্রাটের আমল নেই, কিন্তু আছেন শিল্পপতি। ক্ষেত্রবিশেষে তারাই যেনো হয়ে ওঠেন রাজা বাদশাহ্ কিংবা সম্রাটের মতোই ক্ষমতাবান। আর সেই ক্ষমতার রজ্জুকে ধরে রাখতে গিয়ে অন্যায্য সিদ্ধান্তও নিতে হন বাধ্য। আবার তাদের সাহচর্য হাসিলের মোহে অনেকে নিজের অস্তিত্বকেও ভুলে যান। আপাতদৃষ্টিতে ভালোটা করতে গিয়ে ভয়ানক পরিণতি ঘটার হিসেবটা কেউই কষতেই চান না। পরিণামে বিপত্তি ঘটার পরই সেটিকে ঘিরে চারদিকে শুরু হয় মাতামাতি। তাও আবার ক্ষেত্রবিশেষে। অনেকে ইতিহাস থেকেও হারিয়ে যান। ‘যেখানে ক্ষমতা আছে, সেখানে বিপদও আছে’ দিনশেষে এটাই হয়ে থাকে চিরন্তন।
                                     #
® এইচ.এম. সিরাজ : কবি, সাংবাদিক ও শিক্ষানবিশ অ্যাডভোকেট, ব্রাহ্মণবাড়িয়া।
নির্বাহী সম্পাদক- দৈনিক প্রজাবন্ধু, পাঠাগার ও ক্রীড়া সম্পাদক- ব্রাহ্মণবাড়িয়া প্রেস ক্লাব।
Post Under