এইচ.এম. সিরাজ, ব্রাহ্মণবাড়িয়া
হুমায়ুন কবির, নজরুল ইসলাম স্বপন এবং আবদুল হাই। ওরা তিনজন শ্রমিক নেতা। ব্রাহ্মণবাড়িয়া সড়ক ও জনপথ (সওজ) বিভাগের শ্রমিক-কর্মচারীদের কাছে তিনারা ‘রক্তচোষা’ নেতা হিসেবেও পরিচিত। সাধারণ শ্রমিক-কর্মচারীদের থেকে পদে পদেই টাকা আদায়, শোষণ করা তাদের কাজ। সম্প্রতি ঘুষের টাকা লেনদেনে তারাই বহুল আলোচিত। তাদের দেয়া পাচঁ লাখ টাকাসহ ধরা খেয়ে অডিটর কুতুব উদ্দিন গেলেন জেলহাজতে, হয়েছেন বরখাস্ত। বদলী হয়েছেন অপর দুইজন কর্মমকর্তা। অন্যদিকে স্রেফ অভিযোগকারী আর স্বাক্ষী হয়েই ‘রক্তচোষা’ ওই তিন নেতা ফেলছেন স্বস্তির নি:শ্বাস।
পাঁচ লাখ টাকা ঘুষ গ্রহণের দায়ে ৫৪ ধারায় জেলে পাঠানো হয় অডিটর কুতুব উদ্দিনকে। সাময়িক বরখাস্তও করা হয়েছে এই কর্মকর্তাকে। ঘুষ প্রদানকারীদের একজন নজরুল ইসলাম স্বপন এব্যাপারে একটি লিখিত অভিযোগ দেন ব্রাহ্মণবাড়িয়া সদর মডেল থানায়। ঘুষ দিতে যাওয়া অন্য দু’জন হুমায়ুন কবির ও আবদুল হাই হন এতে স্বাক্ষী। ওই অভিযোগে তাদের বিভাগের শ্রমিক-কর্মচারীদের বেতন ভাতার বিল পাসের জন্যে কুতুব উদ্দিন পাঁচ লাখ টাকা ঘুষ দাবী করেন বলে উল্লেখ করা হয়। তারা বিষয়টি গোয়েন্দা সংস্থাকে অবহিত করেন। জাতীয় নিরাপত্তা গোয়েন্দা সংস্থা-এনএসআই’র জালে গত ২৫ জুন ঘুষের ওই টাকাসহ হাতেনাতে ধরা পড়েন তারা চারজন।
জানা যায়, এর আগে গত ২৩ জুনও তিন নেতা ছয় লাখ টাকা ঘুষ নিয়ে যান ট্রেজারী অফিসে। ঘুষ লেনাদেনায় অডিটর কুতুব উদ্দিন পুরোপুরি ফাঁসলেও সড়ক ও জনপথের কর্মচারী ও শ্রমিক সংগঠনের ওই তিন নেতা স্রেফ অভিযোগকারী আর স্বাক্ষী হয়ে ফেলছেন স্বস্তির নি:শ্বাস। সওজ বিভাগের কার্য সহকারি হুমায়ুন কবির এবং নজরুল ইসলাম স্বপন শ্রমিক ইউনিয়নের সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক। গার্ড আবদুল হাই শ্রমিক কর্মচারী ইউনিয়নের সভাপতি। সওজ ব্রাহ্মণবাড়িয়া বিভাগের শ্রমিক-কর্মচারীদের কাছে তিনজনই ‘রক্তচোষা’ নেতা হিসেবে পরিচিত। সাধারণ শ্রমিক-কর্মচারীদের কাছ থেকে পদেপদে টাকা আদায়, শোষণ করাই তাদের কাজ। অভিযোগ রয়েছে শ্রমিক কর্মচারীদেরকে যেকোন কাজের জন্যে টাকা দিতে হয় তাদেরকে। জোর করেও টাকা রেখে দেন তারা। জেলায় কর্মরত ৬৩ জন মাষ্টাররোল কর্মচারীর চাকরি নিয়মিতকরণ হলে বড় মওকা পেয়ে যান এই তিন নেতা। বকেয়া বেতন-ভাতা উত্তোলনে মোটা অঙ্কের টাকা হাতিয়ে রাখার পরিকল্পনা করেন হুমায়ুন, নজরুল আর আবদুল হাই। ট্রেজারী অফিসে দেয়ার কথা বলে ১৮ পার্সেন্ট টাকা কেটে রাখা হবে বলে সিদ্ধান্ত দেন তারা। ধাপে ধাপে শ্রমিক কর্মচারীদের বিল পাস করিয়ে এনে নিজেদের ভাগের টাকা কেটে রাখেন তারা।
সুত্র জানায়, বিল পাস হওয়ার পর ব্যাংক থেকে টাকা উত্তোলন করে অফিসে আনার পর ওই নেতারা এবং হেডক্লার্ক ও হিসাবরক্ষক একত্রে বসে পার্সেন্টেজের টাকা কেটে রাখেন। টাকা না পাওয়া পর্যন্ত যেসব কর্মচারীর বিল পাস হয়েছে তাদেরকে ছায়ার মতো ঘিরে রাখেন তারা। শুধু তাই নয়, এর বাইরে ওই তিন নেতা আম খাওয়ার কথা বলে প্রত্যেকের কাছ থেকে ১০ হাজার করে টাকা কেটে রাখেন। অসহায় শ্রমিক-কর্মচারীরা পদে পদে টাকা খুইয়ে চোখের জল ফেলতে ফেলতে ঘরে ফেরেন। তাদের এই জুলুমের কথা বলার সাহসও পাননা।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন কর্মচারী জানান, ‘আমার সাড়ে চার লাখ টাকা বিলের মধ্যে আমি পেয়েছি তিন লাখ ৭০ হাজার টাকার মতো। ট্রেজারী খরচ হিসেবে আমার কাছ থেকে এই টাকা কেটে নেয়া হয়।’ আরেকজন কর্মচারী চার লাখ আট হাজার টাকার মধ্যে পেয়েছেন তিন ৩ লাখ ৩০ হাজার টাকা। এভাবে সব কর্মচারীদের কাছ থেকেই টাকা কেটে রাখেন তারা। এর আগে বিল তৈরির জন্যেও প্রত্যেকের কাছ থেকে ৭/৮ হাজার টাকা করে আদায় করা হয়। চাকরি নিয়মিতকরণ হলে বদলীর জন্যেও অনেকের কাছ থেকে ৪০/৫০ হাজার টাকা আদায় করেন ওই নেতারা। কার্য সহকারি নজরুল ইসলাম ও হুমায়ুন কবির সড়ক মেরামত ও উন্নয়নের বিভিন্ন কাজে অনিয়মের সুযোগ দিয়ে মোটা অঙ্কের টাকা কামাই করছেন। গার্ড পদে থাকা আবদুল হাই কখনো নিজের দায়িত্ব পালন করেন না বলেই অফিস সূত্র জানায়। তার ডিউটি করেন আরেকজন। নজরুল ইসলাম স্বপনের বিরুদ্ধে প্রধানমন্ত্রীর প্রতিকৃতির পাশে দাঁড়িয়ে উঠানো একটি ছবি দেখিয়ে কর্মচারীদের ভয়ভীতি দেখানোর অভিযোগও রয়েছে। কিন্তু এখন সাধু সেজেছেন তারা। হিসাব রক্ষণ অফিসের চাপে পড়ে ঘুষ নিয়ে গেছেন, এমন গল্প তাদের মুখে।
ঘুষ কেলেঙ্কারির ঘটনায় তোলপাড় চলছে হিসাব মহানিয়ন্ত্রকের কার্যালয় থেকে শুরু করে ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলা একাউন্টস অফিস পর্যন্ত। রোববার সাময়িক বরখাস্ত করা হয় ঘুষ গ্রহণকারী কর্মকর্তা অডিটর কুতুব উদ্দিনকে। একই সাথে জেলা একাউন্টস এণ্ড ফিন্যান্স অফিসের সুপার আবু ইউসুফ নূরুল্লাহ এবং জেলা একাউন্টস এণ্ড ফিন্যান্স অফিসার মোহাম্মদ আলীকে ঢাকায় বদলীর আদেশ পাঠানো হয়। উপ-হিসাব মহানিয়ন্ত্রক(প্রশাসন-১)খায়রুল বাশার মো. আশফাকুর রহমান স্বাক্ষরিত এক আদেশে আবু ইউসুফ নূরুল্লাহকে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ে এবং মোহাম্মদ আলীকে খাদ্য ও দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা মন্ত্রণালয়ে বদলী করা হয়েছে বলে উল্লেখ করা হয়। পাশাপাশি তদন্তও শুরু হয়েছে। মহা-হিসাব নিয়ন্ত্রক কার্যালয়ের ডেপুটি কন্ট্রোলার অব একাউন্টস এ.কে.এম ওয়াহিদুজ্জামান এক সদস্য বিশিষ্ট এই তদন্ত কমিটির প্রধান। তিনি ২৮ জুন রোববার বিষয়ের তদন্তে ব্রাহ্মণবাড়িয়া এসে জেলা প্রশাসক, সড়ক বিভাগের নির্বাহী প্রকৌশলী এবং অডিট অফিসের সংশ্লিষ্টদের সাথে কথা বলেন। এছাড়া তিনি কারাগারে গিয়ে অভিযুক্ত কর্মকর্তা এবং এনএসআই’র কর্মকর্তাদের সঙ্গেও কথা বলেন। দুই কার্য দিবসের মধ্যে তদন্ত প্রতিবেদন দেয়া হবে বলে জানিয়ে তিনি ব্রাহ্মণবাড়িয়া ত্যাগ করেন। অন্যদিকে বিভিন্ন কাজের নামে জোরপূর্বক শ্রমিক-কর্মচারীদের কাছ থেকে টাকা আদায় এবং ঘুষ প্রদানে জড়িত তিন কর্মচারীর ব্যাপারে নিরব সড়ক ও জনপথ বিভাগ। তাদের বিরুদ্ধে কোন পদক্ষেপ নেয়ার আলামত নেই।
ব্রাহ্মণবাড়িয়া সড়ক ও জনপথ (সওজ) বিভাগের নির্বাহী প্রকৌশলী পঙ্কজ ভৌমিক জানান, ‘মাস্টাররোলে কর্মরত কর্মচারীরা তাদের চাকরি নিয়মিতকরণের জন্যে বিগত ২০১৫ সালে মামলা করেন। এর প্রেক্ষিতে ২০১৯ সালে তাদের চাকরি রেগুলার হলে তারা বকেয়া বেতন-ভাতা প্রাপ্য হন। এখানে কর্মরত ৬৩ জনের জন্যে এক কোটি টাকার ওপরে বরাদ্দ এলে তা পাস করাতে ট্রেজারী অফিস থেকে ঘুষের জন্যে চাপ দেয়া হয় বলে কর্মচারী নেতারা আমাকে জানান। ১৬ জনের প্রাপ্য ৪৩ লাখ টাকা বিল পেতেই তারা ওইদিন পাঁচ লাখ টাকা ঘুষ নিয়ে গিয়েছিলেন।’
ব্রাহ্মণবাড়িয়া সদর মডেল থানাধীন ২ নং ফাঁড়ির ইনচার্জ সোহাগ রানা জানান, ‘ওই ঘটনায় নজরুল ইসলাম স্বপন বাদী হয়ে আমাদের কাছে একটি অভিযোগ দেন। এতে সাক্ষী হন হিসাব রক্ষণ অফিসে ঘুষ নিয়ে যাওয়া তার অন্য দুই সঙ্গী হুমায়ুন এবং আবদুল হাই। বিষয়টি দুদকের এখতিয়ার হওয়ায় আমরা অভিযোগটিকে জিডি হিসেবে গ্রহণ করে সেটি দুদক বরাবর পাঠিয়ে দিয়েছি। এখন তারা এর পুরো বিষয় তদন্ত করবেন