একটি নৌকাভ্রমণ ও ইঁদুরের ফাঁসি
এমদাদুল হক সোহাগ:
কুরবানির ঈদের তৃতীয় দিন। কসবা উপজেলার কুটি বাজারের নৌকা ঘাটে সবাই অপেক্ষা করছে আমার জন্য। ছোটভাই জহির, আরজু, শরীফ, আমিনুর সবাই কল দিচ্ছে কোথায় আছি। মোটরসাইকেল নিয়ে ছুটছি নৌকা ঘাটের দিকে। নৌকা ঘাটে মোটর সাইকেল রেখে নৌকায় উঠলাম। কয়েকজন ছাড়া সবাই-ই পরিচিত মুখ। করোনার মধ্যে এমন আয়োজন কিছুটা ভয়ের হলেও বন্দী জীবন থেকে কিছুটা হলেও স্বাধীনতার পরম সুখানুভূতি তৈরি হবে সে বিষয়ে নিশ্চত ছিলাম।
গন্তব্য এখনো ঠিক হয়নি। ইঞ্জিনের নৌকা ছুটছে শিমরাইলের বিলের দিকে। বিস্তীর্ন হাওরে জলরাশি খেলা করছে। জেলেরা মাছ ধরছে। আহা গ্রাম বাংলার কি অপরুপ দৃশ্য। ঈদের আমেজে ছোট, বড় সবাই নৌকা নিয়ে আনন্দে মেতে উঠেছে। অনেক নৌকায় আবার রয়েছে সাউন্ড সিস্টেম। মিউজিকের তালে তালে নেচে গেয়ে উচ্ছ্বাস প্রকাশ করছে। আহা কি দুরন্ত শৈশব। শুরুতে আমার কিছুটা ভয় কাজ করছিলো। কারন আমাদের নৌকাটি ছিলো তুলনামূলক ছোট। এদিক ওদিক হলেই কাত হতে শুরু করে। সেজন্য অবশ্য সবাই সাঁতার জানে কিনা সেটা শুরুতে সতর্ক করেছিলাম। গ্রাম থেকে বেড়ে ওঠা ছেলেরা সাতার জানবেনা এটা কেমন একটা বিস্ময়কর বেপার। ভয় কিছুটা দূর হয়েছে কারন সবাই সাতার জানা টগবগে যুবক।
নৌকায় ওঠা সবাই তিনটি ভাগে ভাগ হয়ে গল্প আড্ডায় মেতে ওঠলো। একদল ভেতরে, আরেকদল উপরে এবং আরেকদল নৌকার সামনের অংশে। আমি অবশ্য ভেতরে রয়ে গেলাম। কারন সবাই আমার ছোট। আমি একমাত্র মুরব্বি। আমার সাথে ভেতরে রয়ে গেলো কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ের সেকশন অফিসার জিসান, কুমিল্লাস্থ কসবা ছাত্রকল্যাণ পরিষদের সভাপতি আল আমিন কাজী রিয়ান, সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল হক অবি, সাংগঠনিক সম্পাদক নুরুল আজম আরজু এবং কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ের রিমন ও আরেক অভি।
কথা হচ্ছে বিভিন্ন বিষয় নিয়ে। স্মৃতিচারণ। মাঝে মাঝে নৌকার ভেতরে বসে চলছে ফটোগ্রাফী। জহিরের কেনা বিভিন্ন খাদ্য সামগ্রীরও চলছে বন্টন। এসব ক্ষেত্রে যে জীবনে যা না খায় সেও নিজের ভাগের বলে দেখাদেখি সব খায় আরকি।
শেষ বিকেলের দিকে নৌকা নবীনগরের বিলের মধ্যে। মাঝি জানতে চাইলেন নৌকা কোথায় নিয়ে যাবেন না উল্টোপথে ফিরবেন। ভাবলাম বিটঘর বাজারের নাম শুনেছি কিন্তু যাওয়া হয়নি। জিঙ্গেস করলাম বিটঘর বাজার কোনদিকে। সবাই তখন বিটঘর যেতে আগ্রহ প্রকাশ করলো। যেইকথা সেই কাজ। বিটঘর বাজারের কাছে নৌকা ঘাটে নিয়ে ভিরানো হলো নৌকা। নেমেই দেখা গেলা ফুটবল খেলাকে কেন্দ্র করে প্রচুর দর্শকের আনাগোনা। যাক খেলার দিকে না গিয়ে শুরুতেই বাজারের দিকে আমরা হাটছি। অনেক বড় বাজার। বাজারে যাওয়ার পরেই জিসান বলে উঠলো এগিকে একটি কালী বাড়ি আছে। চলেন দেখে যাই। কালী বাড়ির দিকে আবার হাটা শুরু। সামনে এগিয়ে যেতেই দেখা গেলো একটি মরা ঈদুর রশিতে ঝুলে আছে। জানতে চাইলাম কে এই কাজ করেছে, কেন করেছে। একজন বললো এই ইঁদুরটি অনেকদিন যাবৎ উত্তর বাজার এলাকার মুদি দোকানদার সোলেমানের মালামাল খেয়ে নষ্ট করে আসছিলো। অনেক কষ্টে টাক পেতে তাকে ধরা হয়েছে। মনের কষ্টে নিজ আদালতে ঈদুরের ফাঁসির রায় দিয়ে সেটি কার্যকর করেছেন এবং সড়কের পাশে ঝুলিয়ে রেখেছেন। ইঁদুরটিকে এভাবে ফাসিতে ঝুলিয়ে রেখে ব্যবসায়ী সোলেমান আজ অনেক খুশি। এতদিন তার মালামাল নষ্টের জন্য যে ক্ষোভ তৈরি হয়েছিলো সেটির অবশ্য আজ নেই। কারন দুষ্ট ঈদুরের বিচার হয়েছে।
সাথে থাকা এক ছোটভাই বললো কত টাকার মালই বা নষ্ট করেছে এই ইঁদুরটি। অথচ আমাদের দেশে হাজার হাজার টাকা লুট করে অনেকের কিছু হয়না। কথাটা শোনে কিছু বললাম না হেসে উড়িয়ে দিলাম। মনে মনে ভাবলাম আসলেই আমাদের দেশে দুর্নীতির দায়ে কতজনের ফাঁসি হয়েছে ?
যাক পৌছে গেলাম কালী বাড়িতে। সবাই বাড়িটির চারপাশ ঘুরে দেখলাম। পাশেই বিশাল দিঘী। বাড়ি সংলগ্ন রয়েছে একটি পাকা ঘাটলা। আশপাশের কেউ-ই বাড়িটির সঠিক ইতিহাস জানাতে পারলেন না। একজন জানালেন এটি একটি জমিদার বাড়ি। একসময় এখানে জমিদারেরা থাকতেন। এই বাড়িটি থেকেই অত্র অঞ্চলের জমিদারী নিয়ন্ত্রণ করা হতো। বর্তমানে জরাজীর্ন। তবে বাড়িটির নির্মাণশৈলী অত্যন্ত চমৎকার। আমাদের সাথে থাকা সবাই ছবি তুলতে ভুল করেনি। মাগরিবের আজানের ধ্বনি কানে বেজে উঠলো। ফিরতে হবে। সেজন্য দেড়ি না করে আবার নৌকার উদ্দেশ্যে হাটা। আবারো সোলেমানের দোকানের সামনে ফাসিতে ঝুলতে থাকা সেই হতভাগ্য ইঁদুরের দিকে নজর।
যাইহোক, বিটঘর বাজারে এসে মচমচে মুরালির দিকে নজর গেলো। বাসার জন্য ও ছোটভাইদের জন্য কিনে নিলাম। সবাই আবার লেবুর সরবতও খেতে ভুল করেনি। জহির রায়হান আবার সবার জন্য সিঙ্গারা পেয়াজু কিনেছে। নৌকায় উঠে এবার শুরু হলো কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যারয়ের ছোট ভাই রিমনও অবির গিটারের সাথে জেমসের অসাধারণ গান। যদিও ইঞ্জিনের আওয়াজে গান তেমনটা উপভোগ করা যায়নি। তবে নৌকার উপরে বসে লুডু খেলাও আনন্দ দিয়েছে অনেক।
নৌকাভ্রমন আয়োজনে যারা কষ্ট করেছে তাদের মধ্যে জহির রায়হান, নুরুল আজম আরজু, আসাদুজ্জামান, আমিনুর, আল আমিন কাজী রিয়ান, ওবায়দুল হক অবি, শরীফ উদ্দিন, রাফি, নাজমুল অন্যতম ছিলো।