ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় হরতালে দুইজনসহ নিহত ১০, ব্যাপক ভাঙচুর-অগ্নিসংযোগ

এইচ.এম. সিরাজ, ব্রাহ্মণবাড়িয়া
ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় হেফাজতে ইসলাম আহুত সকাল-সন্ধ্যা হরতাল চলাকালে দুইজন নিহত হয়েছে। এই নিয়ে তিন দিনে নিহতের সংখ্যা ১০ জনে উন্নীত হলো।হরতাল চলাকালে সাংবাদিক-পুলিশসহ আহত হয়েছে অন্তত অর্ধশত। হরতাল পালনকালে বিক্ষুব্ধ হরতালকারীরা বিভিন্নস্থানে সরকারি-বেসরকারি গুরুত্বপূর্ণ অফিস, আওয়ামী লীগের দলীয় কার্যালয় ও বাড়িঘরে ব্যাপক হামলা-ভাঙচুর-অগ্নিসংযোগের ঘটনা ঘটায়। ফলে জেলায় অরাজকতার অবস্থার সৃষ্টি করে। এসময় আল আমিন (২০), আশিক (৩৫) নামে দুইজন নিহত হয়েছে। এ নিয়ে নিহতের সংখ্যা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১০ জনে। শহরজুড়ে চলছে থমথম অবস্থা।

রোববার সকাল ১১টার পর থেকে সশস্ত্র কর্মীরা জেলা শহরের হালদারপাড়াস্থ জেলা আওয়ামী লীগের কার্যালয়, জেলা পরিষদ কার্যালয়, জেলা পরিষদের প্রধান নির্বাহীর গাড়িসহ তিনটি মোটরসাইকেল, সুর সম্রাট ওস্তাদ আলাউদ্দিন খাঁ পৌর মিলনায়তন, পৌরসভা ভবন, শহীদ ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত ভাষা চত্বর, জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদকের কার্যালয়, জেলা শিল্পকলা একাডেমী, ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলা গণ গ্রন্থাগার, সুর সম্রাট ওস্তাদ আলাউদ্দিন সঙ্গীতাঙ্গন, সদর উপজেলা ভূমি অফিস, জেলা আওয়ামী লীগের সাধারন সম্পাদক আল মামুন সরকারের বাসভবন, জেলা ছাত্রলীগের সভাপতি রবিউল হোসেন রুবেল ও সাধারণ সম্পাদক শাহাদত হোসেন শোভনের বাড়িতে আগুন দিয়ে জ্বালিয়ে দেয়া হয়। শহরের শহীদ ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত ভাষা চত্বরে জেলা প্রশাসনের উদ্যোগে আয়োজিত উন্নয়ন মেলার ৩২টি স্টলে অগ্নিসংযোগ করা হয়। এছাড়া ব্রাহ্মণবাড়িয়া প্রেস ক্লাব, ব্যাংক এশিয়া, জেলা মুক্তিযোদ্ধা সংসদ কমপ্লেক্স, শহরের আনন্দময়ী কালীবাড়ির মন্দিরের মুর্তি, বিজয়নগর উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি জহিরুল ইসলাম ভূইয়ার নিজস্ব অফিস, বিজয়নগর উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান নাসিমা মুকাই আলীর শহরের হালদারপাড়াস্থ বাসভবনে ব্যাপক ভাঙচুর চালানো হয়।

ব্রাহ্মণবাড়িয়া প্রেস ক্লাবে হামলার সময় প্রেস ক্লাব সভাপতি রিয়াজ উদ্দিন জামি গুরুতর আহত হন। এদিকে সকাল থেকে বিকেল পর্যন্ত শহরের দক্ষিণ পৈরতলা, পীরবাড়ি,জেলা পুলিশ লাইন, কুমিল্লা-সিলেট মহাসড়কের বিশ্বরোড এলাকাসহ বিভিন্ন স্থানে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সাথে বিক্ষোভকারীদের ব্যাপক সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে। এদিকে দুপুর সাড়ে ১২টার দিকে থানা মসজিদ থেকে পুলিশের পক্ষ থেকে মাইকিং করে থানায় হামলা না চালাতে মাদ্রাসাছাত্রদের অনুরোধ করা হয়। নিরাপত্তার কারণে ঢাকা-চট্টগ্রাম-সিলেট, ও ঢাকা-নোয়াখালীর পথে ট্রেন চলাচল বন্ধ রয়েছে। রোববার সকাল নয়টার দিকে ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় চট্টগ্রামগামী সোনার বাংলা এক্সপ্রেসে ভাঙচুর চালানো হয়। খুলে ফেলা হয় রেললাইনের নাট-বল্টু।

রোববার সকালে হেফাজত ইসলামের কেন্দ্রীয় নায়েবে আমীর মাওলানা সাজিদুর রহমানের নেতৃত্বে জামিয়া ইসলামিয়া ইউনুছিয়া মাদ্রাসা প্রাঙ্গণ থেকে বিক্ষোভ মিছিলটি বের হয়। মিছিলটি শহরের প্রধান প্রধান সড়ক প্রদক্ষিণ শেষে প্রেস ক্লাবের সামনে এক সংক্ষিপ্ত সভা করে। বক্তব্য রাখেন হেফাজত ইসলামের কেন্দ্রীয় উপদেষ্টা ও জেলার সাধারণ সম্পাদক ও জামিয়া ইসলামিয়া ইউনুছিয়া মাদ্রাসার মোহতামিম (প্রিন্সিপাল) মুফতি মোবারক উল্লাহ, জামিয়া ইসলামিয়া ইউনুছিয়া মাদ্রাসার শিক্ষা সচিব মাওলানা শামসুল হক, কওমী প্রজন্ম ব্রাহ্মণবাড়িয়ার মুখপাত্র হাফেজ মুফতি এরশাদুল্লাহ প্রমূখ। শনিবার জেলার বিভিন্ন স্থানে সংর্ঘষে অন্তত আটজন নিহত হয় বলে হেফাজত ইসলামের কেন্দ্রীয় নায়েবে আমীর ও দারুল আরকান মাদ্রাসার প্রিন্সিপাল মাওলানা সাজিদুর রহমান জানান। এছাড়াও আরো অনেক ছাত্র গুরুতর আহত হয় বলে তিনি দাবী করেন।

উল্লেখ্য, ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর বাংলাদেশ সফরের প্রতিবাদে গত শুক্রবার থেকেই ব্রাহ্মণবাড়িয়া বিরাজ করতে থাকে থমথমে অবস্থা। বিশেষত জেল সদর পরিণত হয় রণক্ষেত্রে। শুক্রবা রাতেই মোতায়েন করা হয় বিজিবি। রোববার হরতাল চলাকালে নিহতেরা হলেন জেলার সরাইল উপজেলার কুট্টাপাড়া গ্রামের সুফি আলীর পুত্র আল আমিন (২০) এবং সদর উপজেলার বুধল ইউনিয়নের খাঁটিহাতা গ্রামের আসিক মিয়া (৩৫)। আড়াইশ’ শয্যাবিশিষ্ট ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেনারেল হাসপাতালের তত্ত্বাবধায়ক শওকত হোসেন দুইজনের মৃত্যুর বিষয়টি নিশ্চিত করেন। এর আগে গত ২৭ মার্চ জেলার বিভিন্ন স্থানে সংর্ঘষে নিহত হয় এক মাদ্রাসাছাত্রসহ অন্তত ছয়জন। তারা হলেন ব্রাহ্মণবাড়িয়া সদর উপজেলার বুধল ইউনিয়নের নন্দনপুর হারিয়া গ্রামের আবদুল লতিফ মিয়ার পুত্র ওয়ার্কসপ দোকানী জহিরুল হক ওরফে জুরু আলম (৩৫), বুধল গ্রামের আওয়াল মিয়ার পুত্র প্লাম্বার শ্রমিক কাউছার মিয়া (২৫), শরীফপুর গ্রামের মাদ্রাসাছাত্র যুবায়ের (১৪), মজলিশপুর ইউনিয়নের মৈন্দ গ্রামের জোহর আলীর পুত্র সুজন মিয়া (২২), আখাউড়া উপজেলার মনিয়ন্ধ গ্রামের মাওলানা হোসাইন (২২), সুনামগঞ্জের দিরাই উপজেলার চরনারচর ইউনিয়নের লৌলারচর গ্রামের দাবির মিয়ার পুত্র ওয়ার্কসপ শ্রমিক বাদল মিয়া (২৪) এবং শনিবার রাতে ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেনারেল হাসপাতালে নূরুল আমিন (২৬) নামের এক যুবকের মৃত্যু ঘটে। এর আগে গত ২৬ মার্চ শুক্রবার বিকেলে জেলা শহরের দাতিয়ারা গ্রামের সাগর মিয়ার পুত্র আশিক (২৫) নিহত হয়। এদিকে রোববার হরতাল চলাকালে সাংবাদিক-পুলিশসহ আহত হয়েছে অন্তত অর্ধশত। গত ২৬ মার্চ শুক্রবার থেকে ২৮ মার্চ রোববার বিকেল নাগাদ নিহতের সংখ্যা ১০ জনে উন্নীত হয়েছে।

Post Under