আজিজুর রহমান চৌধুরী:
৩৪ বৎসর যাবত পত্রিকা নিয়ে ছুটেছেন হকার উপেন্দ্র। কাক ডাকা ভোরে পাখির কিচির মিচির শব্দে ঘুম ভাঙতেই ব্যস্ততা বেড়ে যায় উপেন্দ্রের। পত্রিকা সরবরাহকারী এই হকার বাইসাইকেল নিয়ে ছুটেছেন উপজেলা সদর নাসিরনগরে। বৎসরের ৩৬৫ দিনই তার ব্যস্ততার ঘাটতি নেই। চৈত্রের খর দুপুরে, কাল বৈশাখীর ঝড়ে, আষাঁঢ়ের মুশলধারা বৃষ্টি, মাঘের বাঘ পালানো শীতেও নেই তার ক্লান্তি। অক্লান্ত পরিশ্রমী উপেন্দ্র ৩৪ বৎসর যাবত বিরামহীন ভাবে চালিয়ে যাচ্ছে তার এই দায়িত্বশীল পেশা। তার মহৎ কাজে প্রথম থেকেই সেবা দিয়ে আসছে তার শ্যালক তাপস(৪৫)।
উপজেলার গোকর্ণ ইউনিয়নের চটিপাড়া গ্রামে ১৯৬০ সালে তার জন্ম। ১৯৮৬ সাল থেকে মাত্র ৩০ কপি পত্রিকা নিয়ে তার যাত্রা শুরু। আজ তার গ্রাহক সংখ্যা ৫ শতাধিক। যদিও কোভিড(১৯) এ শতাধিক ব্যবসায়ী পত্রিকা পড়া ছেড়ে দিয়েছে।
২০০৪ইং সেইভ দ্যি সিল্ড্রেন(ইউ এস এ) এরিয়া ম্যানেজার কলিমুল্লা কলির নির্দেশে জাবেদ আহমেদ তাকে একটি ভাল বাইসাইকেল উপহার দেন। এতে উপেন্দ্রের গতিমাত্রা বৃদ্ধি পায়। মাঝে মধ্যে তার ছেলে পিয়াসও তাকে সাহায্য করে আসছিল। সেই সময় জেলার প্রত্যন্ত অঞ্চল হিসেবে নাসিরনগর উপজেলার পরিচিতি ছিল। যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন নাসিরনগরে ভাল কর্মকর্তা কর্মচারী আসতে অনীহা প্রকাশ করত। আবার আসলে কেউ যেতেও চাইতনা। এই প্রতিকূল অবস্থা পেরিয়ে উপেন্দ্র দ্বারে দ্বারে পত্রিকা বিলি করত।
একসময় সরাইল বিশ্বরোড থেকে বাইসাইকেলে পত্রিকা নিয়ে আসতে হতো। বর্তমানে বিশ্বরোড থেকে এজেন্ট কর্তৃপক্ষ সিএনজি যোগে পত্রিকার গাইড নাসিরনগর সদরে পৌছিয়ে দেন। পূর্বে যেখানে সে প্রায় একশত কিলো রাস্তা দৌড়িয়ে পত্রিকা বিলিয়ে রাতে বাড়ি ফিরতো সেখানে বর্তমানে মাত্র ৩০ কিলোমিটার রাস্তা অতিক্রম করে দুপুর বারো টার মধ্যেই বাড়ি ফিরতে পারে। কৈশর পেরিয়ে যৌবন অতিক্রম করে স্ত্রী, এক ছেলে, এক মেয়েকে নিয়ে যখন একটু সস্থি পেলো তখনি আত্মীয় স্বজনের আহ্বানে মেয়ে ভারতী রাণীকে ভৈরব বাজার ব্যবসায়ী অনন্ত পালের নিকট বিয়ে দিয়ে প্রশান্তি লাভ করে। বিধি বাম ঠিক সেই সময় কোভিড-১৯ এর থাবায় এক মাত্র ছেলে পিয়াস (২৮) স্ট্রোক করে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েন। গত ২০এ এপ্রিল ২০২০ ইং ছেলেকে হাড়িয়ে উপেন্দ্র কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে পড়েন। পিতা হয়ে মৃত ছেলেকে কাঁধে বহনের জ্বালা উপেন্দ্র অনুভব করেছে বলে জানায়। উপজেলার ১৩টি ইউনিয়নের মধ্যে বেশ কয়েকটি ইউনিয়ন সহ প্রায় সমগ্র নাসিরনগরেই পত্রিকা নিয়ে তার বিচরণ। হকারী জীবনের সুখ-দুঃখ, হাসি-কান্না, সময়ে-অসময়ে অট্টহাসি, পুত্র হারানোর বেদনা সব মিলিয়ে সে সুস্থ আছে বলে জানায়। এ সেবাদানকারী উপেন্দ্র শেষ জীবন পর্যন্ত এ পেশায় থেকে মানুষের সেবা করে যেতে চান বলে এ প্রতিবেদনকারীকে জানান।