তানভীর মাহতাব আবীর
দেশে কিন্ডারগার্টেন স্কুল আছে প্রায় ৬৫ হাজার। করোনা মহামারীতে গত প্রায় চার মাস যাবত স্কুল বন্ধ থাকায় বিপাকে পড়েছেন কিন্ডারগার্টেন স্কুলগুলোর সাথে সংশ্লিষ্ট প্রায় দশ লাখ শিক্ষক- কর্মচারী।
কিন্ডারগার্টেন বলতে সাধারণত বেসরকারি পর্যায়ের প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলোকে বুঝায়। প্লে শ্রেণী থেকে পঞ্চম শ্রেণী পর্যন্ত পড়ার সুযোগ আছে এসব স্কুলে। তবে কোনো কোনো কিন্ডারগার্টেনে অষ্টম শ্রেণী পর্যন্তও পড়ানো হয়।
১৮৩৭ সালে জার্মান শিশু-শিক্ষানুরাগী ব্যক্তিত্ব ফ্রেডরিখ ফ্রোয়েবল ব্যাড ব্ল্যাংকেনবার্গে শিশুদেরকে বাড়ি থেকে বিদ্যালয় পর্যন্ত গমন এবং খেলা ও প্রাতিষ্ঠানিক কর্মকাণ্ডে অংশগ্রহণের মাধ্যমে শিক্ষা গ্রহণের ধারণাকে কেন্দ্র করে কিন্ডারগার্টেন শিক্ষা ব্যবস্থার প্রবর্তন করেন। ক্রমেই এই শিক্ষা ব্যবস্হাটি সারা বিশ্বে জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। বাংলাদেশেও এর ব্যতিক্রম হয় নি।
১৯৭৪ সালে কুদরাত-ই-খুদা এবং ১৯৮৮ সালে মফিজউদ্দিন আহমেদের নেতৃত্বাধীন শিক্ষা কমিশন শিশুদের শিক্ষার গুরুত্ব বিবেচনায় শহর ও শিল্প এলাকার সকল শিশুদের জন্য নার্সারি বা কিন্ডারগার্টেন প্রতিষ্ঠার সুপারিশ করে। ১৯৯৫ সালে গঠিত সবার জন্য শিক্ষা-সংক্রান্ত জাতীয় কমিটি ‘সবার জন্য শিক্ষা’ লক্ষ্য অর্জনের ক্ষেত্রে ছোট শিশুদের শিক্ষার গুরুত্ব স্বীকার করে এবং প্রাক-প্রাথমিক শিক্ষা ব্যবস্থার প্রবর্তন ও উন্নয়নের লক্ষ্যে বেশ কয়েকটি সুপারিশ পেশ করে।
জাতীয় শিক্ষানীতি প্রণয়নের জন্য ১৯৯৭ সালে গঠিত কমিটির সুপারিশেও একই কথা বলা হয় এবং সেই সাথে শিশুদের শিক্ষা দানের জন্য বিশেষভাবে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত মহিলা শিক্ষকদের নিয়োগ করারও পরামর্শ দেয়। দেশে শিশুদের জনসংখ্যার বিপরীতে অপর্যাপ্ত সরকারি প্রাক-প্রাথমিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের পক্ষে শিক্ষা কমিশনগুলোর সুপারিশ বাস্তবায়ন করা বেশ দূরুহের ব্যাপারই। এর ফলে ব্যক্তি উদ্যোগে প্রতিষ্ঠিত কিন্ডারগার্টেনগুলো জাতীয় শিক্ষা ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য অবদান রাখছে। নার্সারি স্কুল বা কিন্ডারগার্টেনের আদলে ছোট শিশুদের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের সংখ্যাও এজন্য দিন দিন বৃদ্ধি পেয়েছে।
বরাবরই ব্যক্তি উদ্যোগের এসব প্রতিষ্ঠান নানামুখী চ্যালেন্জ নিয়ে শিক্ষাদান করে গিয়েছে। ভাড়া বাড়ি, চাহিদার তুলনায় অপ্রতুল শিক্ষক ও ক্লাসরুম, শিক্ষকদের সীমিত সুযোগ সুবিধার মত নানান সীমাবদ্ধতার মাঝেও সামর্থ্যের সবটুকু দিয়ে শিক্ষাগ্রহণের পথে শিশুদের প্রথম হাতেখড়ি দেয়া হয় এসব স্কুলে। করোনার মহামারীতে মানুষ গড়ার এই কারিগরদের এখন এক প্রকার মানবেতর জীবনযাপনই করতে হচ্ছে।
করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাবের কারণে গত ১৬ মার্চ থেকে বন্ধ রয়েছে দেশের সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠানসহ কিন্ডারগার্টেনগুলো। সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকরা সরকার থেকে নিয়মিত বেতন পেলেও সম্পূর্ণ নিজস্ব আয়ে চলা কিন্ডারগার্টেনগুলো পড়েছে চরম বিপাকে। স্কুল বন্ধ থাকায় শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে মাসিক বেতন পাচ্ছেন না স্কুল কর্তৃপক্ষ।
এতে করে মাসের পর মাস স্কুল ঘরের ভাড়া থেকে শুরু করে শিক্ষক- কর্মচারীদের বেতনও দিতে পারছেন না স্কুলের মালিকেরা। বিভিন্ন স্হানে দেনা শোধ করতে না পেরে স্কুল বিক্রি করে দেয়ার বিজ্ঞাপনও চোখে পড়েছে বেশ কয়েকটি স্হানে। একমাত্র আয়ের এই পথ বন্ধ হয়ে যাওয়ায় গত চার মাস ধরে বিপাকে আছেন বেতন না পাওয়া শিক্ষক- কর্মচারীরা। কুমিল্লার এক কিন্ডারগার্টেন শিক্ষক বলছিলেন তার মানবেতর জীবনের কথা, ‘মধ্যবিত্ত হওয়ায় কারো কাছে হাতও পাততে পারি না। কিন্তু পেট কি আর চক্ষু লজ্জা বুঝে? খেয়ে না খেয়ে দিন কাটছে আমাদের। ‘
কিন্ডারগার্টেনের এসব শিক্ষক- কর্মচারীরা এই অবস্হা থেকে উত্তরণে প্রধানমন্ত্রীর হস্তক্ষেপ কামনা করেছেন। এজন্য বেশ কয়েকবার তারা মানববন্ধনও করেছেন। সর্বশেষ গত ০৮ জুলাই ঢাকা, কুমিল্লা, নারায়ণগঞ্জসহ দেশের বিভিন্ন স্হানে বাংলাদেশ কিন্ডারগার্টেন এসোসিয়েশনের ব্যানারে মানববন্ধন ও সমাবেশ হয়েছে। এই মানববন্ধন থেকে শিক্ষকরা প্রধানমন্ত্রীর ঘোষিত আর্থিক প্রণোদনা কিন্ডারগার্টেন শিক্ষকদের জন্য বরাদ্দ দেয়ার এবং সহজ শর্তে ঋণ প্রদান করে এই আর্থিক দূরাবস্থা থেকে উত্তোরণ সরকারি সহায়তার দাবী জানান।
এর আগে গত মে মাসে কিন্ডারগার্টেন শিক্ষকরা প্রধানমন্ত্রীর কাছে তাদের অসহায়ত্বের কথা তুলে ধরে খোলা চিঠি লিখেন।