কুমিল্লায় ডুবতে বসা বিআরটিসিতে অর্ভূতপূর্ব উন্নয়ন, লোকসান কাটিয়ে লাভে
নেপথ্যে বিআরটিসির চেয়ারম্যান মো: তাজুল ইসলাম
এমদাদুল হক সোহাগ:
বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্পোরেশনের কুমিল্লার বাস ডিপো ও প্রশিক্ষণ কেন্দ্রে লেগেছে আধুনিকতার ছুঁয়া, পেয়েছে সমৃদ্ধি ও নান্দনিকতা। দৃষ্টিনন্দন পরিবেশ নজর কাড়ছে সকলের। এক সময় নিয়মিত বেতন দিতে না পারা কুমিল্লার বিআরটিসি এখন লোকসান কাটিয়ে হয়েছে লাভজনক প্রতিষ্ঠান।
অথচ গত তিন বছর আগেও দুর্নীতি, লোকসান, অবকাঠামো সহ নানা প্রতিবন্ধকতায় ডুবতে বসেছিল রাষ্ট্রায়াত্ব এই প্রতিষ্ঠানটি। সেই বিআরটিসি এখন ঘুরে দাড়িয়েছে, উদাহরণ হয়েছে কিভাবে ঘুরে দাড়াতে হয়। লোকসান, বেতন দিতে না পারা, কাদা পানি, ময়লা আবর্জনা, ভাঙ্গাচুড়া গাড়ি, জরাজীর্ন ভবন, দুর্নীতি সহ নানা অভিযোগে যখন জর্জরিত ঠিক তখনই আশার আলোর মশাল নিয়ে বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্পোরেশন (বিআরটিসি) এর চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্বভার গ্রহণ করেন অতিরিক্ত সচিব মো: তাজুল ইসলাম। বিআরটিসি চেয়ারম্যান মো: তাজুল ইসলাম এক সময় কুমিল্লার নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট, সদরের টিএনও, এডিএম, জেলা পরিষদের সচিব, কুমিল্লার অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক রাজস্ব হিসেবে সুনামের সাথে দায়িত্ব পালন করে গেছেন। বিআরটিসিতে যোগদানের আগে তিনি প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব (প্রশাসন) হিসেবে দায়িত্ব পালন করে দেশব্যাপী প্রশংসা লাভ করেন। তাঁর গ্রামের বাড়ি ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার কসবা উপজেলার সৈয়দাবাদ গ্রামে।
তিনি বিআরটিসির দায়িত্ব গ্রহণের পরই সারা বাংলাদেশে মুখ থুবরে পড়া বিআরটিসিকে টেনে তুলার জন্য নিরলস প্রচেষ্টা শুরু করেন। তার জাদুকরি নেতৃত্বে সারা বাংলাদেশে বিআরটিসির অবৈধ সিন্ডিকেট ভেঙ্গে দুর্নীতির লাগাম টেনে ধরতে সক্ষম হন। তিনি স্লোগান দেন, আয় বৃদ্ধি ও ব্যায় সংকোচন এবং যাত্রী সেবার মানোন্নয়ন। এই স্লোগানকে ধারণ করে এগিয়ে চলেন। সীমিত সম্পদের সর্বোচ্চ ব্যবহার, ডিজিটালাইজেন, সুষ্ঠু পরিকল্পনা, সততা ও নিষ্ঠার সাথে কাজ করায় সারা বাংলাদেশে বিআরটিসির আধুনিকায়ন সহ লাভজনক প্রতিষ্ঠানে পরিনত হয়েছে। বিআরটিসির এই যাদুকরি উত্থান স্বয়ং প্রধানমন্ত্রীরও প্রশংসা কুড়িয়েছেন। মাসের ১ তারিখ বেতন পাচ্ছেন সারা বাংলাদেশের সকল কর্মকর্তা-কর্মচারী। যোগ হয়েছে বিভিন্ন উৎসব বোনাস সহ নানা আর্থিক সুবিধা।
এদিকে সারা বাংলাদেশের সাথে সাথে চেহারা পাল্টেছে কুমিল্লা বাস ডিপো ও প্রশিক্ষণ কেন্দ্রের। জরাজীর্ন একতলা প্রশাসনিক ভবন এখন দৃষ্টিনন্দন দুতলা। দৃষ্টিনন্দন ডিজিটাল গেট, চারিদিকে উচু ও আধুনিক সীমানা প্রাচীর, ড্রেনেজ ব্যবস্থার উন্নয়ন, জলাবদ্ধতা থেকে মুক্ত হতে পুরো মাঠ বালু, মাটি ও ইট ফেলে সংস্কার, আধুনিক যন্ত্রপাতি, জনবল বৃদ্ধি, শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত যাত্রী বিশ্রামাগার, প্রশিক্ষণ শ্রেণিকক্ষ ডিজিটাল ও শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত, অতিথিশালা, বাস রাখার নতুন আধুনিক শেড, বাস মেরামতের জন্য আধুনিক শেড, পুরাতন বাস মেরামত করে নতুনের মতো করা, যাত্রী সেবার মানোন্নয়ন, আধুনিক দৃষ্টনন্দন আসবাবপত্র সমৃদ্ধ অফিস কক্ষ, মুজিব কর্ণার সহ প্রতি মাসের ১ তারিখ কর্মকর্তা-কর্মচারীদের নিজস্ব আয় থেকে ডিজিটাল ব্যাংকিং পদ্ধতিতে বেতন-বোনাস প্রদান, ভেহিক্যাল ট্রেকিং সিস্টেম (ভিটিএস, সেইপের মাধ্যমে প্রশিক্ষণ দিয়ে জনশক্তি রপ্তানির জন্য দক্ষ নাগরিক তৈরি, বিনামূল্যে লাইসেন্স, বেসিক ড্রাইভিং প্রশিক্ষণ সহ হয়েছে অভূতপূর্ব উন্নয়ন। কুমিল্লা স্টেশন রোড দিয়ে ধর্মপুর পূর্ব চৌমুহনী যেতেই এখন নজর কাড়ে আধুনিক ও দৃষ্টনন্দন বিআরটিসির বাস ডিপো ও প্রশিক্ষণ কেন্দ্র।
বিআরটিসির সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা যায়, কুমিল্লা বাস ডিপো ও প্রশিক্ষণ কেন্দ্রটি ১.৪৪ একর ভূমির উপর প্রতিষ্ঠিত। দীর্ঘদিন অবহেলায় পুরো প্রতিষ্ঠানটি ময়লার ভাগাড়ে পরিনত হয়। অধিকাংশ জায়গা ডুবে থাকতো ময়লা পানিতে, বৃষ্টি হলে কাদা, হাটু সমান পানি লেগে থাকতো দিনের পর দিন, কঁচু খেত ও ঝোপে সাপ, পোকামাকড় ও মশা তৈরীর কারখানা হয়েছিল। ভাঙ্গা ও অনুচ্চ সীমনা প্রাচারীর জন্য অরক্ষিত ছিলো পুরো ডিপো। পরিবেশ ছিল অস্বাস্থ্যকর। লোকসান আর লোকসানে থাকা বিআরটিসি গত দুই বছরে চমক দেখিয়েছে। গত ২২-২৩ অর্থ বছরে প্রতিষ্ঠানটি আয় করে ১৩ কোটি ৮৪ লাখ ৯ হাজার ২০৩টাকা। মোট ব্যায় হয় ১৩ কোটি ৭০ লাখ ৩৯ হাজার ২২৭টাকা। নীট লাভ হয় ১৩ লাখ ৬৯ হাজার ৯৭৬ টাকা। গত দুই অর্থ বছরে ডিপোটিতে প্রায় ৫ কোটি টাকার উন্নয়ন কাজ হয়েছে। ২০২১-২০২২ অর্থবছরে প্রতিষ্ঠানটির মোট আয় দাড়ায় ১১ কোটি ৫৩ লাখ ০৪ হাজার ৭৩০ টাকায়। ব্যায় হয় ১১ কোটি ১১ লাখ ৬৫ হাজার ৬৫৩ টাকা। নীট আয় দাড়ায় ৪১ লাখ ৩৯ হাজার ৭৭ টাকায়।
বিআরটিসির অফিস সূত্র জানায়, বর্তমানে ডিপোতে ৮৫জন স্থায়ী ও ১৭ জন অস্থায়ী কর্মকর্তা কর্মচারী রয়েছে।
বিআরটিসির ৯টি রুটে ২৩টি গাড়ি চলাচল করছে। কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয় এবং কুমিল্লা সিসিএন বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী পরিবহনে স্বল্প ভাড়ায় ১৪টি গাড়ি চলাচল করছে। ৯টি রুটের মধ্যে কুমিল্লা-সিলেট, কুমিল্লা -সুনামগজ্ঞ, কুমিল্লা জাফলং (এসি সার্ভিস), চান্দিনা-ঢাকা(গুলিস্তান এসি সার্ভিস), ফরিদগঞ্জ-সিলেট, লক্ষীপুর-সিলেট, গুলিস্থান-বোয়ালমারী(এসি সার্ভিস) ও গৌরিপুর-ঢাকা (এসি সার্ভিস) চলমান আছে। কুমিল্লা থেকে ঢাকা বাস সার্ভিস এক সময় জনপ্রিয় ও নির্ভরযোগ্য হলেও বাস সংকটের কারনে পরিচালনা সম্ভব হচ্ছেনা। তবে শীঘ্রয়ই কুরিয়া থেকে বিআরটিসি বহরে ৩৪০টি বাস যুক্ত হতে যাচ্ছে। তখন নতুন বাস দিয়ে কুমিল্লা-ঢাকা সার্ভিস পুনরায় চালু হবে।
এদিকে বিআরটিসির ব্যবস্থাপনায় সেইপ প্রকল্পের মাধ্যমে বিনামূল্যে ড্রাইভিং, ইংরেজী ও আরবী ভাষা প্রশিক্ষণ শেষে বিনামূল্যে লাইসেন্স সহ প্রশক্ষণার্থীদের ১২ হাজার টাকার অনুদান দেয়ার প্রকল্পটি ব্যাপক সুনাম অর্জন করেছে। চার মাস অন্তর অন্তর ১৫০জন যুবক-যুবতীকে প্রশিক্ষণ দেয়া অব্যাহত রয়েছে। ২০১৮ সাল থেকে এখন পর্যন্ত এক হাজার ৪০০জন প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেছেন এবং ১১০০জনের লাইসেন্স কার্যক্রম সম্পন্ন হয়েছে। এই প্রকল্পের মাধ্যমে গরীর ও নিম্ন আয়ের মানুষ বেশী উপকৃত হচ্ছেন। দেশে দক্ষ চালকের পাশাপাশি যারা বিদেশ যাচ্ছেন তারা একজন দক্ষ অভিবাসী হিসেবে সফলতা লাভ করছেন। তাছাড়া বিআরটিসির বেসিক প্রশিক্ষণেও তৈরী হচ্ছে দক্ষ চালক। এতে করে দুর্ঘটনার হার কমছে।
কুমিল্লা বাস ডিপোর সিনিয়র বাস চালক ও প্রশিক্ষক আবদুল হানিফ স্বপন জানান, নতুন চেয়ারম্যান যোগদানের আগে ডিপোর পরিবেশ অত্যন্ত নাজুক ছিলো। ডিপোর ভেতরে পানি লেগে থাকতো। খানা খন্দে বাস ঢুকানো মুশকিল ছিল। কাদা পানি, আবর্জনায় পরিবেশ বিপর্যস্ত ছিল। ঠিকমতো বেতন ভাতা পেতাম নাহ। হতশাগ্রস্থ হয়ে পড়েছিলাম। তাজুল ইসলাম স্যার দায়িত্ব নেয়ার পর আমাদের কপাল খুলেছে। এখন চাকরি করে আনন্দ পাচ্ছি। ভবিষ্যত নিয়ে দুশ্চিন্তা দূর হয়েছে। মাসের ১ তারিখ বেতন-বোনাস, উৎসব ভাতাও পাচ্ছি। ডিপোর এত উন্নয়ন হবে কল্পনাও করিনি। এমন পরিবর্তনে আমরা খুবই আনন্দিত।
ডিপো ও প্রশিক্ষণ কেন্দ্রের কারিগরি প্রধান আরিফুর রহমান জানান, কুমিল্লা ডিপোতে একসময় খোলা মাঠে কাজ করতে হয়েছে। ওয়ার্কিং শেড ছিলোনা। ছিলোনা যন্ত্রপাতি ও জনবল। এখন গাড়ি মেরামতের জন্য সকল ধরনের আধুনিক যন্ত্রপাতি ও চমৎকার ওয়ার্কিং শেড নির্মান হয়েছে। কাজের পরিবেশ হয়েছে নান্দনিক।
ডিপো ও প্রশিক্ষণ কেন্দ্রের কনডাক্টর লিয়াকত আলী খান বলেন, বিআরটিসিতে অল্প বয়সে চাকরি হয়। আমার কর্মজীবন ৩৯ বছর। চাকরি আছে আর মাত্র ৬ মাস। বিগত দুই আড়াই বছরে কুমিল্লা সহ সারা বাংলাদেশে যে উন্নয়ন ও পরিবর্তন এসেছে বিগত ৩০ বছরেও তা হয়নি। ডিপোর ভেতরে পরিবেশ না থাকায় আমাদের বাস পার্কিং করতে হয়েছে সড়কের উপর-রেলের জায়গাতে। অথচ ডিপোর ভেতরেই এখন শতাধীক বাস পার্কিংয়ের সুব্যবস্থা আছে।
কুমিল্লা বাস ডিপো ও প্রশিক্ষণ কেন্দ্রের ম্যানেজার (অপারেশন) মোহাম্মদ আবদুল কাদের জিলানী বলেন, চেয়ারম্যান স্যারের আয় বৃদ্ধি, ব্যয় সংকোচন ও যাত্রী সেবার মানোন্নয়ন এই স্লোগান ধারন করে সারা বাংলাদেশের ন্যায় কুমিল্লা বাস ডিপোও এগিয়ে চলছে। লোকসান আর জরাজীর্নতা কাটিয়ে আমরা লাভজনক প্রতিষ্ঠানের পাশাপাশি তৈরি করেছি অবকাঠামোর অর্ভূতপূর্ব উন্নয়ন ও নান্দনিক কর্মপরিবেশ। যাত্রীসেবার মান আগের চেয়ে বেড়েছে কয়েকগুণ। ডিপোর নিজস্ব আয় থেকে মাসের ১ তারিখ বেতন বোনাস ডিজিটাল ব্যাংকিং পদ্ধতিতে পরিশোধ সহ বেড়েছে কর্মকর্তা-কর্মচারীদের পেনশন সহ বিভিন্ন ভাতা ও আর্থিক সুবিধা। আমাদের ডিপোতে নতুন বাস যুক্ত হওয়ার প্রক্রিয়া চলমান আছে। এতে করে যাত্রী সেবার মান আরো বৃদ্ধির পাশাপাশি আয়ও বহুলাংশে বৃদ্ধি পাবে। কুমিল্লা থেকে ঢাকার বাস সার্ভিস আবারো চালু হবে। ইতিমধ্যে যাত্রীদের শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত বিশ্রামাগার, ড্রাইভিং প্রশিক্ষণার্থীদের জন্য ডিজিটাল ও শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত ক্লাসরুম, নারীদের জন্য নামাজের স্থান, মসজিদের উন্নয়ন সহ বিভিন্ন ডিজিটাল কার্যক্রম সম্পন্ন হয়েছে। সব কিছুর জন্য আমাদের চেয়ারম্যান মো: তাজুল ইসলাম স্যারের কাছে আমরা কৃতজ্ঞ। স্যারের দক্ষ নেতৃত্বে আমরা আরো সমৃদ্ধির পথে এগিয়ে যাবো।