ব্রাহ্মণবাড়িয়া অডিট অফিস ঘুষের আখড়া তদন্ত কমিটির রিপোর্ট

এইচ.এম. সিরাজ, ব্রাহ্মণবাড়িয়া
‘এটা একটা ঘুষের আখড়া। ঘুষ ছাড়া এখানকার এক টেবিল থেকে আরেক টেবিলে একটা কাগজও নড়ে না। এটা কোনো অফিস নয়, যেনো ঘুষের গুদাম ঘর।’ এমনি নানান কথা চাউর হচ্ছে ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলা হিসাব রক্ষণ অফিস তথা অডিট অফিস সম্পর্কে। পাঁচ লাখ টাকা ঘুষ লেনদেনকালে অডিটর কুতুব উদ্দিন আটকের পর থেকেই আলোচনায় চলে আসে এখানকার ঘুষ লেনদেনের ঘটনা। মুখ খুলতে শুরু করেন ভূক্তভোগীরা।

ব্রাহ্মণবাড়িয়া হিসাব শাখায় ঘুষ লেনদেনের ঘটনায় সড়ক ও জনপথ বিভাগের নজরুল ইসলাম বাদী হয়ে সদর মডেল থানায় ৫৪ ধারায় একটি মামলা করেছেন। এতে সওজ’র হুমায়ুন কবীর ও আব্দুল হাইকে করা হয়েছে স্বাক্ষী। অবশ্য সওজ’র এই তিন নেতাই ঘুষ প্রদান করতে গিয়েছিলেন হিসাব রক্ষণ অফিসে। সওজ কর্মীদের বকেয়া বেতন-ভাতার বিল পাসের জন্য পাঁচ লাখ টাকা ঘুষ দাবী করে বলে তাদের অভিযোগে উল্লেখ করেন। বিষয়টি তারা জাতীয় নিরাপত্তা গোয়েন্দা সংস্থা (এনএসআই) অফিসকে অবিহিত করলে গোয়েন্দার জালে আটক হয় অডিটর কুতুব উদ্দিন। মামলার নথি কুমিল্লার দুদক কার্যালয় থেকে সিদ্ধান্ত গ্রহণের জন্য পাঠানো হয়েছে ঢাকায়।

গত ২৫ জুন বৃহস্পতিবার পাঁচ লাখ টাকা ঘুষ গ্রহণকালে হাতে নাতে আটক হয় ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলা হিসাব রক্ষণ অফিসের অডিটর কুতুব উদ্দিন। এরপর থেকে নানা অনিয়ম ও দুর্নীতির খবর বেরিয়ে আসতে থাকে। অবৈধ এসব কাজ বৈধ হিসবেই চলছে অডিট অফিসে। সড়ক ও জনপথ বিভাগের মাষ্টার রোলে কর্মরত ৬৩ জন কর্মীর চাকরি স্থায়ী হলে বর্ধিত বেতনে এক কোটি সাত লাখ টাকার বিল বকেয়া আসে। এ টাকা পেতে অডিট অফিসের সাথে পাঁচ লাখ টাকায় চুক্তি করেন হিসাব রক্ষণ অফিসের অডিটর কুতুব উদ্দিন। চুক্তি মোতাবেক প্রথম দফায় ৬৪ লাখ টাকা নিয়ে যায়। অবশিষ্ট ৪৩ লাখ টাকার বিল করা হয়েছিলো বৃহস্পতিবার। বিলের চেক নিতে আসা সওজ কর্মচারীরা ওই সময় চুক্তি অনুযায়ী অডিটর কুতুব উদ্দিনকে পাঁচ লাখ টাকা দেন। ওই লেনদেনের সময়ই অডিটর কুতুব উদ্দিন আটক হন ন্যাশনাল সিকিউরিটি ইন্টিলিজেন্স (এনএসআই) হাতে।

পাঁচ লাখ টাকা ঘুষ কেলেঙ্কারির ঘটনায় ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলা একাউন্টস এণ্ড ফিন্যান্স অফিসের অডিটরকে সাময়িক বরখাস্ত করাসহ দুই কর্মকর্তাকে করা হয়েছে বদলী। জেলা একাউন্টস এণ্ড ফিন্যান্স অফিসের সুপার আবু ইউসুফ নুরুল্লাহ এবং জেলা একাউন্টস এণ্ড ফিন্যান্স অফিসার মোহাম্দ আলীকে ঢাকায় বদলী করা হয়েছে। ২৮ জুন রোববার উপ-হিসাব মহানিয়ন্ত্রক(প্রশাসন-১)খায়রুল বাশার মো. আশফাকুর রহমান তাদের বদলীর আদেশে স্বাক্ষর করেন। আবু ইউসুফ নুরুল্লাহকে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ে এবং মোহাম্মদ আলীকে খাদ্য ও দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা মন্ত্রণালয়ে বদলী করা হয়। অপরদিকে পাঁচ লাখ টাকা ঘুষ গ্রহণকালে এনএসআই’র হাতে আটককৃত অডিটর কুতুব উদ্দিনকে পাঠানো হয় জেলহাজতে। তাকে করা হয়েছে সাময়িক বরখাস্ত। রোববার হিসাব মহানিয়ন্ত্রণ কার্যালয় থেকে আগত তদন্ত টিম ঢাকায় ফিরে গিয়ে এই সিদ্ধান্তের কথা জানান।

বাড়তি পারিশ্রমিক (ঘুষ) হিসেবে অতিরিক্ত অর্থ আদায়ের ঘটনা ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় সৃষ্টি হয়েছে ব্যাপক চাঞ্চল্যের। জেলা হিসাব রক্ষণ অফিসে দীর্ঘদিন ধরে ওপেন সিক্রেট ঘুষ লেনদেন চলছে বলে আলোচনায় উঠে এসেছে। স্থানীয় ঠিকাদার মমিনুল হক বলেন, ‘স্বচ্ছতার সাথে কাজ করে বিল নিয়ে ট্রেজারী অফিসে যাওয়ার পর সেখানে কর্মরতরা নানা ছলছাতুরীর মাধ্যমে আদায় করেন মোটা অঙ্কের অর্থ। লাখে সাড়ে চার হাজার টাকা না দিলে বিল পাস করা হয় না।’ আরেক ঠিকাদার ছগির আহমেদ জানান, ‘মানসিকভাবে বিপর্যস্ত করে নানান কলাকৌশল অবলম্বন করে আমাদেন কাছ থেকে আদায় করা হয় টাকা। অফিসে ফাইলটা যাবার পরই ইন্টারনেটে ধীরগতি, কাজের ভীষণ চাপ, লোকবল সঙ্কটসহ নানা অজুহাত দেখিয়ে তারা তাদের পার্সেন্টিজ আদায় করা হয়।’ সড়ক ও জনপথ বিভাগের শ্রমিক-কর্মচারীদের কাছ থেকে তাদের বকেয়া বিল পরিশোধে ২০ পার্সেন্ট চাওয়া হয়। পরে দর কষাকষিতে পাঁচ লাখ টাকা স্থির করা হয়। একটি সূত্র জানায়, তাদের ১২ টি বিলের বিপরীতে এখনো অন্তত ৪০/৫০ লাখ টাকা প্রদান বাকি রয়েছে। এই বিল কৌশলে আটকে রেখেছে জেলা হিসাব রক্ষণ অফিস।

ব্রাহ্মণবাড়িয়া সদর মডেল থানার পরিদর্শক (ওসি) মুহাম্মদ সেলিম উদ্দিন জানান, ‘এটি আমাদের এখতিয়ার নয়। ৫৪ ধারায় একটি মামলা হয়েছে। আমরা মামলার নথি দুদক কার্য্যালয়ে পাঠিয়ে দিয়েছি।’ সচেতন নাগরিক কমিটি (সনাক) ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলা কমিটির সহ-সভাপতি আবদুন নূর বলেন, ‘ঘুষ আদান-প্রদান চিরতরে বন্ধ হোক, এটা আমাদের দাবী।’ জেলা একাউন্টস এন্ড ফিন্যান্স অফিসার মোহাম্মদ আলী বলেন, ‘এখানকার অর্থ লেনদেনের বিষয়ে আমার কোনো ধারণা নেই। আমি এ জেলায় নতুন যোগদান করেছি।’ ব্রাহ্মণবাড়িয়া সড়ক ও জনপথ বিভাগের (সওজ) নির্বাহী প্রকৌশলী পঙ্কজ ভৌমিক জানান, ‘মাস্টাররোলে কর্মরত কর্মচারীরা তাদের চাকরি নিয়মিতকরণের জন্য বিগত ২০১৫ সালে মামলা করেন। এর প্রেক্ষিতে ২০১৯ সালে তাদের চাকরি রেগুলার হওয়ায় তারা বকেয়া বেতন-ভাতা প্রাপ্য হন। এখানে কর্মরত ৬৩ জনের জন্য এক কোটি টাকার ওপরে বরাদ্দ আসলে তা পাস করাতে হিসাব রক্ষণ অফিস থেকে ঘুষের জন্য চাপ দেয়া হয় বলে কর্মচারী নেতারা আমাকে জানান। ১৬ জনের প্রাপ্য ৪৩ লাখ টাকা বিল পেতেই তারা ওইদিন পাঁচ লাখ টাকা ঘুষ নিয়ে গিয়েছিলেন।’

তদন্ত কমিটির প্রধান এবং হিসাব মহানিয়ন্ত্রক কার্যালয়ের ডেপুটি কন্ট্রোলার জেনারেল অব একাউন্টস এ.কে.এম ওয়াহিদুজ্জামান বলেন, ‘এ ঘটনায় ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলা হিসাব রক্ষণ অফিসের অডিটর কুতুব উদ্দিনকেও সাময়িক বরখাস্ত করা হয়েছে। ঘুষ লেনদেনের বিষয়ে জেলা প্রশাসক, সড়ক ও জনপদ বিভাগের নির্বাহী প্রকৌশলী, এবং হিসাব রক্ষণ অফিস সংশ্লিষ্টদের সাথে কথা হয়েছে। জমা দেয়া হয়েছে তদন্ত প্রতিবেদন। সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ এ বিষয়ে পরবর্তী সিদ্ধান্ত নেবেন।

Post Under