কমলার ভাগ্য বিড়ম্বনা প্রকৃতি এখন জীবন সাথী

আজিজুর রহমান চৌধুরী:

তোরা দেখে যা আসিয়া কমলার নিত্য বরণ চমকিয়া চমকিয়া। জীবনের শেষ প্রান্তে এসেও নীলাভ স্বপ্নে বিভোর কমলা (৫০) রং খুঁজে পায়নি। খোলা আকাশের নিচে তার ঠাঁই। আকাশ হলো তার ছাদ। ঘরবাড়ি,স্বামী,সন্তান,পরিবার- পরিজন সবই এখন তার স্মৃতির অতলে হারা। কমলা দেবীর একদিন সবই ছিলো। লাল শাড়ি পড়ে বধু সেঁজে স্বামীর সংসারে পা রেখেছিলেন। সুখ-দুঃখের দোলাচলে রঙিন স্বপ্নে বিভোর হয়ে কাটিয়ে দিয়েছেন কতোদিন। সংসারে আসছে নতুন মুখ লিলু ও অবিন্যাস নামে দুটি সন্তান। ১৫ বছর বয়সে কমলার বিয়ে হয় নাসিরনগর উপজেলার কুন্ডা ইউনিয়নের বৈরাচং গ্রামে। কমলার বাবার বাড়ি কিশোরগঞ্জ জেলার ফরিদপুর গ্রামে। তার পিতার নাম প্রয়াত শ্রীনন্দ দাস। স্বামী রামচন্দ্র দাসের সান্নিধ্যে কমলা যখন সংসার গুছাতে লাগলো, বিধিবাম দুরারোগ্য ক্যান্সারে অকালেই রামচন্দ্র দাস মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েন। স্বামীর চিকিৎসায় সামান্য জমি-জমা হাতছাড়া করে হয়ে পড়েন নিঃস্ব। ১৯৮৮ ইং এর ভয়াবহ বন্যায় দিশেহারা কমলার ঘাড়ে উঠে ঋণের বোঝা। শুরু হয় কায়িক পরিশ্রম। বিভিন্ন বাড়িতে কাজ করে জীবিকা নির্বাহ করতো। কাজ করানোর সুবাদে সবাই তাকে করতো আদর-স্নেহ। একপেট খাবার দিয়ে আদায় করে নিতো গৃহিনীর নিত্যপ্রয়োজনীয় দিনের কাজ। কায়িক ও পারিবারিক পরিশ্রমে কমলা দিন দিন দুর্বল হতে থাকে। এভাবে কাটিয়ে দেয় প্রায় এক যুগ। পাড়া-প্রতিবেশী ও ভাসুর শ্রীকান্তের তীক্ষ্ণদৃষ্টি সবকিছু সয়েও কমলা স্বামীর ভিটে ছাড়েনি। ছেলে অবিনাশকে এ প্রতিবেদকের সহায়তায় কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা হয়। উপজেলা সদর নাসিরনগর বাজারে মন্টু গোপের চা স্টলে তার চাকুরী হয়। অন্যদিকে পাড়া-প্রতিবেশীদের সহায়তায় একমাত্র মেয়ে লিলুকে নাসিরনগর সদর পূর্বপাড়ায় সিবু সরকারের নিকট বিয়ে দেয়া হয়। মেয়ের বিয়ের পর কমলা একটু স্বস্তি পেলো। এরমধ্যেই পাড়া-পড়শীর জোর দাবির প্রেক্ষিতে একমাত্র ছেলে অবিনাশকে বিয়ে করাতে বাধ্য হয়। পার্শ্ববর্তী কুন্ডা গ্রামের রীনা দাসের সহিত অবিনাশের বিয়ে হয়। কিন্তু বিধিবাম কমলার ভাগ্যে সুখ জুটলো না। ছেলে বিয়ের কিছুদিনের মধ্যেই আউলাকেশী পাগল বেশে কমলা নাসিরনগর সদরে চলে আসে। আশ্রয় নেয় কোর্ট বিল্ডিংয়ের দরজা বিহীন পরিত্যক্ত একটি কামরায়। আসবাবপত্রের মধ্যে রয়েছে দুটো পলিথিনের ব্যাগ। একটির মধ্যে দুটি কাপড়। অন্যটির মধ্যে রয়েছে কয়েকটি ছেড়া কাগজ। পাশে রয়েছে একটি ছালার ব্যাগ, যার মধ্যে লাকড়ি সহ কিছু জ্বালানি দ্রব্য। অদ্যবধি তার সর্বশেষ আশ্রয়স্থল থানা রোডে হাজ্বী খালেক মিয়ার বিল্ডিংয়ের বারান্দায়। বিশ্বব্যাপী করোনায় যখন মানব সমাজ কম্পিত,কমলা তখন নির্বাক।
প্রকৃতির ঝড়-বৃষ্টি,শীত-গরম তার নিত্য সাথী। সাপ-বিচ্ছু, করোনা-ডেঙ্গু সবকিছুকেই উপেক্ষা করে প্রকৃতিকে সে হার মানিয়েছে। এখন আর কমলার কদর নেই। দেখবার ও কেউ নেই। পেটের দায়ে মাঝে মধ্যে রাস্তায় কাগজ কুঁড়াতে দেখা যায়। স্বামীর শোকে পাগল কমলার ভাগ্যের নির্মম পরিহাস গত ৫ই মে একমাত্র ছেলে অবিনাশ হঠাৎ  বুকের ব্যাথায় অস্থির হয়ে মৃত্যুবরণ করেন। কমলা তার ছেলের মৃত্যুর সংবাদ বিশ্বাস করেনি। বাড়িতেও যায়নি। যদিও চিতায় তার ছেলেকে একনজর চুপিচুপি দেখে এসেছে। সে এখন নির্বাক নিস্তব্ধ। রাত দুপুরে তার বুক ফাঁকা আর্তনাদ শুনা যায়। তার দুই চোখে এখন শুধু গাঢ় অন্ধকার, কেমন আছেন জিজ্ঞেস করলে হাউমাউ করে কেঁদে উঠেন।

Post Under