প্রকৃতি বদলে দিচ্ছে করোনা!

তানভীর মাহতাব আবীর:
কোনো একদিন সকালে ঘুম থেকে উঠে যদি শুনতে পান পৃথিবীতে আর দূষণ নামের কোনো শব্দ নেই, হারিয়ে গেছে গ্রিন হাউজ এফেক্টের চোখ রাঙানি। কিংবা পত্রিকা খুলে যদি দেখেন, কোথাও আর ঝড় জলোচ্ছ্বাসের মতো প্রাকৃতিক দুর্যোগের খবর নেই। কেমন হবে জলবায়ু পরিবর্তনের বহুল পরিচিত গল্পটার এমন উল্টো ঘটতে দেখলে?

জলবায়ু পরিবর্তনের জন্য দায়ী করা হয় মানুষকেই। নিজেদের স্বার্থে আমরা প্রাকৃতিক সম্পদের ধ্বংস করে যাচ্ছি কোনো রকম বাছবিচার ছাড়াই৷ আমাদের আচরণ কিংবা মনোভাব যদি পরিবর্তন না হয় তাহলে জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব সম্পর্কিত আশঙ্কা বদলাবে না কখনোই। আশার কথা হচ্ছে, প্রকৃতিরই আরেক মহামারিতে মানুষকে তার আচরণ পরিবর্তনে বাধ্য করে প্রকৃতি তার চেনা রূপে ফিরছে।

কোভিড-১৯ নামে পরিচিত চীন থেকে ছড়িয়ে পড়া প্রাণঘাতী করোনা ভাইরাস ইতোমধ্যে বিশ্বের ১৮৮টিরও বেশি দেশে বিস্তৃতি ঘটিয়েছে, আক্রান্ত হয়েছে এক কোটিরও বেশি মানুষ। একইসাথে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে মৃত্যুর মিছিল। দিন যত যাচ্ছে দেশ থেকে দেশে জরুরি অবস্থা জারি হচ্ছে, স্থবির হয়ে পড়ছে অর্থনীতি, ঘর-বন্দি থাকতে হচ্ছে অসংখ্য মানুষকে।

মানুষের এই প্রতিদিনকার আচরণ এবং স্বভাবসুলভ কাজগুলোতে পরিবর্তন আনার ফলে পরিবেশের ওপর কিছু সূক্ষ্ম প্রভাব পড়ছে। বিভিন্ন দেশে লকডাউনে স্কুল, কলেজ, কারখানা বন্ধ হয়ে পড়ায় ফলে গ্রিন হাউজ গ্যাসের নির্গমন হার কমেছে।

যুক্তরাজ্য ভিত্তিক জলবায়ু পরিবর্তন বিষয়ক ওয়েবসাইট কার্বন ব্রিফের এক প্রতিবেদন বলছে, সম্প্রতি চীনে প্রায় ২৫ শতাংশ কার্বন ডাই-অক্সাইড নির্গমন কমেছে। প্রায় একই চিত্র এখন যুক্তরাষ্ট্রেরও। দেশটিতে গ্রিনহাউজ গ্যাস

নিঃসরণে সবচেয়ে বেশি দায়ী করা হয় পরিবহন খাতকে। স্কুল এবং ব্যবসা প্রতিষ্ঠানগুলি বন্ধ হয়ে পড়ার ফলে মানুষ সরকারি নির্দেশনা মেনে ঘর-বন্দি থাকছে, ফলে দেশটির যোগাযোগ ব্যবস্থা স্তিমিত হয়ে পড়েছে। এতে করে কার্বন নিঃসরণ উল্লেখযোগ্য হারে হ্রাস পাওয়ার আভাস মিলেছে যুক্তরাষ্ট্রের জনপ্রিয় বিজ্ঞান সাময়িকী সায়েন্টিফিক অ্যামেরিকান এর এক প্রতিবেদনে।

গণ-পরিবহনের বিষাক্ত কালো ধোঁয়া পরিবেশের জন্য আরেক অভিশাপ। বাংলাদেশের পরিবেশ অধিদফতরের এয়ার কোয়ালিটি ইনডেক্স থেকে পাওয়া তথ্যমতে, ঢাকা শহরে প্রতিদিন গড়ে প্রায় তিন লাখ যান্ত্রিক যানবাহন চলাচল করে। এসব যানবাহনের বিরাট একটি অংশ বায়ু দূষণের জন্য দায়ী। এসব মোটরযান থেকে ক্ষতিকর বস্তুকণা নির্গত হয়।

পরিবেশ বিজ্ঞানীরা বরাবরই স্বল্প দূরত্বে গণ-পরিবহন ব্যবহার নিরুৎসাহিত করে বাইসাইকেলের মত পরিবেশ বান্ধব যানবাহন ব্যবহারের পরামর্শ দিয়ে আসছেন। যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্ক স্টেট ট্রান্সপোর্টেশন বিভাগের সাম্প্রতিক এক তথ্য পরিবেশ বিজ্ঞানীদের সেই পরামর্শটিকেই যেন মনে করিয়ে দিচ্ছে। তথ্য বলছে, সম্প্রতি নিউইয়র্ক শহরে ব্রিজগুলোর উপরে বাইসাইকেল চলাচলকারীর সংখ্যা উল্লেখযোগ্য হারে বৃদ্ধি পেয়েছে। যদিও এটি পরিবেশের কথা ভেবে করছে না কেউ, তবু করোনা ভাইরাসের সংক্রমণ ঝুঁকি এড়াতে চলাচলে এটাই কার্যকর যান বলে মানুষ বেছে নিচ্ছে এবং পরোক্ষভাবে পরিবেশেরই উপকার করছে।

ফিরে আসি বাংলাদেশে। করোনাভাইরাসের বিস্তার রোধে বিশ্বের দীর্ঘতম সমুদ্র সৈকতে পর্যটক কিংবা স্থানীয়দের ভ্রমণের ওপর নিষেধাজ্ঞা রয়েছে। সৈকতের বুকে জনমানবের পদচারণা না থাকায় নীরবে সবুজ গালিচা তৈরি করায় ব্যস্ত সাগরলতা। সবুজ এ গালিচায় ফুটেছে অগণিত জাতের নাম না জানা বাহারি রঙের সব ফুল। বাসা বেঁধেছে লাল কাঁকড়া, শামুক-ঝিনুক ও গাঙ কবুতরের দল। বিচরণ বেড়েছে কচ্ছপেরও। বিপন্ন প্রজাতির তালিকায় থাকা এই প্রাণী পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষায়, বিশেষ করে খাদ্যশৃঙ্খল বজায় রাখতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।
মার্চ মাসে বহু বছর পর সমুদ্রে ডিগবাজিতে মেতেছে ডলফিন। ডলফিনের এ মনোমুগ্ধকর নৃত্য যেন পরিবেশ-প্রকৃতির এক অপার লীলা। এদিকে কলকারখানা বন্ধ থাকার কারণে দূষণ কমেছে বুড়িগঙ্গা, কর্ণফুলী, হালদাসহ দেশের বড় নদীগুলোতে। তবে পরিবেশের এই সাময়িক উপকার উদযাপনের কোনো উপলক্ষ হওয়া উচিত নয়, ইতিহাস বলছে, এমন অবস্থা কেটে যাওয়ার পর কার্বন নিঃসরণের হার তার আগের জায়গায় ফিরে যেতে সময়ক্ষেপণ করেনি।

এই ভাইরাসের প্রাদুর্ভাব কেটে গেলে মানুষ আবার তার নিয়মিত জীবনে ফিরবে, কার্বন নিঃসরণের নিম্নমুখী হার আবার উপরে উঠতে সময় লাগবে না, যদি
না আমরা শিক্ষা নিতে পারি করোনা ভাইরাসের এই দুঃসময়টা থেকে। খুব কম সময়ের ব্যবধানে মানুষের ভেতর আমূল পরিবর্তন কতদিন স্থায়ী হবে সেটা এখন বড় প্রশ্ন। পরিবেশ সচেতন হওয়ার কিংবা পরিবেশ নিয়ে ভাবার নতুন এই সুযোগ আমরা আদৌ কাজে লাগাতে পারবো নাকি জলবায়ু পরিবর্তনের ভয়াবহতার অপেক্ষাতেই থাকতে হবে সময়ের কাছে থাকুক এই প্রশ্ন।

ফিচার লেখক।
শিক্ষার্থী: পরিবেশ বিজ্ঞান ও দূর্যোগ ব্যবস্থাপনা বিভাগ,
নোয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়।

Post Under