এইচ.এম. সিরাজ
ভবের এই খেলা ঘরে খেলে সব পুতুল খেলা। জানিনা এমন খেলা ভাঙে কখন কে জানে। বানাইয়াছে পুতুল যিনি এক দিন ভাঙবে তিনি, জানে সে কোন্ খেলাতে ভাঙে পুতুল আপন মনে। বাউল সাজে কেউ সংসার সাজায় খুশিমতো, স্বার্থের কারণে ঘুরে সবাই অবিরত অরে মানুষ যতো। দেখি বেহুশ হয়ে আছে সবাই, ভাবে না চিরটিকাল রবে না কেউ এইখানে- ভবের এই খেলা ঘরে খেলে সব পুতুল খেলা।’ আসলেও একদমই তাই। কেই-বা জানে কার খেলা কখন সাঙ্গ হবে!তবুও আমরা লোভের আতিশয্যে আকণ্ঠই থাকি নিমজ্জিত। বাউলের বেশ ধারণ করেও অনেকেই গড়ে তুলেন নিপুণ সংসার। সমাজের মানুষ মনে করেন, সে তো বাউল। কিন্তু সে-ই যে তলে তলে তালতলাগামী! এই খবর কে রাখে? মুলত স্বার্থের কারণেই মানুষ জগৎ সংসারে অবিরত ঘুরছে।
পৈত্রিক সম্পত্তি। হিস্যানুপাতে সকল ওয়ারিশানেরাই প্রাপক কিংবা ভাগীদার।কিন্তু বাস্তবতায় আমরা দেখছি কী? বাস্তব ঘটে যাওয়া একটা ঘটনারই উল্লেখ করছি। তিন পুত্র সন্তান রেখে হাজি শওকত আলী মারা যান। পিতৃত্যাজ্য সম্পত্তিতে ওরা তিনজনই সমান হিস্যাদার বটে। কিন্তু বাস্তবিকে সবকিছুই বড় ভাইয়ের জিম্মায়। এসব নিয়েই তিন সহোদরের মধ্যে দেখা দেয় বিরোধ। ক্রমেই তা ভয়ানকতার দিকে হয় ধাবিত। ক্রমেই ছোট দুই ভাই হয়ে ওঠেন বড় ভাইয়ের প্রতিপক্ষ। শেষতক পৈত্রিক ওই সম্পত্তির বিরোধের জেরেই ছোট দুই ভাই মিলে বড় ভাই আমজাদ হোসেনকে (৫০) হত্যা করলো কুপিয়ে ! নারকীয় ঘটনা ঘটিয়েই বাড়ি ছেড়ে পালালো কাউসার, ওসমান নামের ঘাতকদ্বয়েরা। চরম পৈশাচিক আর বর্বরোচিত ঘটনাটি ব্রাহ্মণবাড়িয়ার বিজয়নগর উপজেলা এলাকার।
সেদিন ছিলো রোববার, ১৫ জুলাই ২০১৮ খ্রিষ্টাব্দ। এর পরদিন সোমবার অশীতিপর বৃদ্ধা মাকে নিয়ে হজ্বব্রত পালনের জন্য সৌদীআরবের উদ্দেশ্যে রওনা হবারও কথা পঞ্চাশোর্ধ পুত্র আমজাদ হোসেনের। অথচ এর আগেরদিন রোববার সকালেই সহোদর ছোট ভাইদের জিঘাংসার শিকার হয়ে নির্মমভাবে খুন হলেন আমজাদ হোসেন ! ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার বিজয়নগর উপজেলার সিঙ্গারবিল ইউনিয়ন এলাকার কাশিনগর গ্রামে ঘটে নারকীয় এই হত্যাকাণ্ড। অশীতিপর মাকে নিয়ে হজ্বে যাওয়ার আগেরদিন সহোদর ছোট ভাইদের হাতে বড় ভাই নৃশংসভাবে খুনের ঘটনাটি গোটা এলাকাজুড়েই ব্যাপক চাঞ্চল্যের জন্ম দেয়। এদিকে চরমতম পৈশাচিক আর নারকীয় ঘটনাটির পরপরই ঘাতক ওসমান এবং কাউসার হয়ে যায় বেপাত্তা।
নিহতের পরিবার,স্থানীয় এলাকাবাসী এবং পু্লিশ সূত্রে খবরে প্রকাশ পায়, পৈত্রিক সম্পত্তি নিয়ে ছোট দুই ভাই কাউসার মিয়া এবং ওসমান মিয়ার সাথে বড় ভাই আমজাদ হোসেনের চলছিলো বিরোধ। আমজাদ ১৬ জুলাই সোমবার রাতে বৃদ্ধা মাকে নিয়ে পবিত্র হজ্বব্রত পালনের লক্ষ্যে সৌদীআরবে যাবেন এমনটা নির্ধারণ করাই ছিলো। অপরদিকে হজ্বে যাবার আগেই পৈত্রিক সম্পত্তির বিরোধ নিষ্পত্তি করে দিবেন বলেও সবাইকে জানায়। কিন্তু বাস্তবতায়? সময় যায় পেরিয়ে, কাজের কাজ কিছুই করেনি বড় ভাই আমজাদ হোসেন। এরই প্রেক্ষিতে রোববার সকালে আমজাদের সাথে তার ছোট দুই ভাইয়ের বাদানুবাদের সূত্রপাত ঘটে। এসবেরই এক পর্যায়ে কাউসার এবং ওসমান দা দিয়ে এলোপাথাড়ি আঘাত করে বড় ভাই আমজাদকে। গুরুতর আহত হয় পঞ্চাশোর্ধ বৃদ্ধ আমজাদ হোসেন। ঘটনার শোরগোল শুনে পেয়ে আশপাশের লোকজন আমজাদকে উদ্ধার করে আশঙ্কাজনক অবস্থায় জেলা সদর হাসপাতালে নিয়ে যাবার পথেই তার মৃত্যু হয়।
ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলা সদর হাসপাতালের চিকিৎসক ডা.এ.বি.এম মুসা জানান, ‘হাসপাতালে আনার আগেই ওই ব্যক্তি মারা যান।’ বিজয়নগর থানার পরিদর্শক (ওসি) আলী আরশাদ ঘটনাটির সত্যতা নিশ্চিত করে গণমাধ্যমকে জানান, ‘নিহতের মরদেহ উদ্ধারেরর পর ময়না তদন্ত করানোর জন্য পাঠানো হয়েছে জেলা সদর হাসপাতাল মর্গে পাঠানো হয়েছে। ঘটনার পরপরই দুই ঘাতক বাড়ি ছেড়ে পালিয়েছেন, তাদের গ্রেপ্তার করার জোরালো প্রচেষ্টা চলছে।’ গণমাধ্যম বেশ ফলাও করে এই প্রকাশ করে, আর ঠিক এভাবেই অনেকটা ল্যাটা চুকে যায়। কেই-বা আর তত্ত্ব নিয়ে জানতে যেতে চায়! তাছাড়া এজাতীয় ঘটনা যে এই সমাজে আর ঘটেনাই/ঘটবে না এমনটারই-বা গ্যারান্টি কে দেবে?
সম্পত্তি যেখানে থাকার, ঠিক সেখানটায়ই পড়ে রইলো। হয়তোবা হাত বদল হয়েছে। এটি আকড়ে ধরে রাখতে চেয়েও পারলেন না আমজাদ হোসেন। অথচ পরিণামে নিজেকেই সম্পতি ভোগ দখল থেকে চিরতরে পড়তে হলো ছিটকে। অপরদিকে ওসমান ও কাউসার যদ্দিন এই জগত সংসারে বেঁচে থাকবেন, ততোদিন অবধিই ‘ভ্রাতৃঘাতক’ তকমাটিকে বয়ে বেড়াতেই হবে। ‘মাটির দেহখানি এই মাটিতেই মিশে যাবে, হিসাবের খাতা পরকালের সঙ্গী হবে, অরে সঙ্গী হবে। মিছে দুনিয়াদারি কিছুই রবে না, কি সুখে দালান-কোঠা বানায় সবে কে জানে- ভবের এই খেলা ঘরে খেলে সব পুতুল খেলা। জানিনা এমন খেলা ভাঙে কখন কে জানে।’ বাংলার গানের পাখি খ্যাত এন্ড্রো কিশোরের তুমুল জনপ্রিয় ও কালজয়ী এই গানটিকে আমরা সকলেই অত্যন্ত গুরুত্ব দিয়েই শুনি-ভাবি। কিন্তু বাস্তবতায়—–
লেখক: এইচ.এম. সিরাজ : কবি, সাংবাদিক ও শিক্ষানবিশ অ্যাডভোকেট, নির্বাহী সম্পাদক : দৈনিক প্রজাবন্ধু, ব্রাহ্মণবাড়িয়া।