তানভীর মাহতাব আবীর:
আমাদের স্বপ্ন দেখার অভ্যেস বেশ পুরোনো। নানান সময়ের নানান ভাবনা আমাদের স্বপ্নে এসে ধরা দিয়ে যায়। পরিবেশ নিয়ে স্বপ্ন বা ভাবনাটাও বোধহয় কম নয়৷ জলবায়ু পরিবর্তনের বৈশ্বিক প্রভাব দেশে দেশে দূষণ বাড়াচ্ছে, তাপমাত্রার উর্ধ্বগতিতে গলছে হিমবাহ,লাগামছাড়া কার্বন নিঃসরণ ভাবিয়ে তুলছে, ঝুঁকিতে ফেলছে আগামীর প্রজন্মের বেড়ে উঠায়। আমরা বোধহয় সকলেই স্বপ্ন দেখেছি কোনো একদিন হয়ত হুট করেই পৃথিবীতে আর জলবায়ু পরিবর্তনের চোখ রাঙানি থাকবে না, হারিয়ে যাবে দূষণের ভয়াবহতা।
সেই স্বপ্নে একটুখানি হলেও আশা জাগিয়ে যাচ্ছে করোনা ভাইরাস। যদিও মানুষ, অর্থনীতি থেকে শুরু করে প্রায় সকলকিছুতেই স্হবিরতার তালিকাটাই বড় হয়ে উঠছে মহামারীর দিনগুলোয় তবু পরিবেশের জন্য স্বস্তির গল্পই হয়ে থাকবে এই ভাইরাস। দেশে দেশে লকডাউনে প্রকৃতি ফিরেছে তার আপন রূপে। আমাদের দেশেই তো এমন অসংখ্য ঘটনা উদাহরণ হয়ে এসেছে। আমরা জানি প্রকৃতির এই রূপ একেবারেই ক্ষণস্হায়ী কারণ মহামারী কেটে গেলে মানুষ ফিরবে তার চেনা ব্যস্ততায়, ফের বাড়বে দূষণ, প্রকৃতিও দূষণের অসহায়ত্ব বরণ করে নিতে দেরী করবে না। প্রকৃতিকে বিরক্ত না করলে কোনো রকম প্রতিবন্ধকতা ছাড়াই যে সে তার মতো করেই বেড়ে উঠতে পারে সেটির বড় উদাহরণ হয়ে থাকবে মহামারীর এই দিনগুলো, করোনা অন্তত আমাদের এই শিক্ষাটা দিয়ে যাচ্ছে।
আমরা যে খাদ্য গ্রহণ করি, যে বাতাসে শ্বাস নিই, তৃষ্ণায় পানি পান করি এবং জলবায়ু, যেটি আমাদের গ্রহকে বাসযোগ্য করে তোলে- এসবই তো প্রকৃতির নিঃস্বার্থ অবদান। প্রতি বছর সামুদ্রিক গাছপালা আমাদের বায়ুমণ্ডলের অর্ধেকের বেশি অক্সিজেনের যোগান দেয় এবং একটি পরিপক্ব গাছ প্রায় ২২ কিলোগ্রাম কার্বন ডাই-অক্সাইড শোষণ করে বিনিময়ে অক্সিজেন ছেড়ে দিয়ে মানুষের ক্লান্তিহীন উপকার করছে, বাঁচিয়ে দিচ্ছে মানুষের প্রাণ। আমাদের প্রকৃতি আমাদের যে সমস্ত সুবিধা দেয়, বিনিময়ে আমরা তার সিকিভাগ উপকারও স্বীকার করি না, ভালো থাকতে দিই না তার বেড়ে উঠায় ব্যাঘাত ঘটিয়ে।
তবু সচেতনতা আর নানামুখী উদ্যোগে চেষ্টা চলেই পরিবেশকে পরিবেশের মতোই বাঁচতে দেয়ার। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা গেল মাসে এক অনুষ্ঠানে প্রত্যেককে তিনটি করে গাছ (ফলজ, বনজ ও ওষুধি গাছ) লাগানোর আহ্বান জানিয়েছিলেন। আমাদের খুব আশাবাদি করে এটা দেখে যে, সরকার দলীয় সংগঠন থেকে শুরু করে অসংখ্য মানুষ ব্যক্তিগত উদ্যোগে হোক কিংবা সাংগঠনিকভাবে এই আহ্বানে সাড়া দিয়েছেন। গাছ লাগানোটাই যেখানে বড় এক সমাধান হতে পারে পরিবেশ বাঁচানোর প্রয়াসে, সেখানে এমন উদ্যোগ সত্যিকার অর্থেই বোধহয় প্রশংসার দাবিদার। তবে প্রতিবছরই লক্ষ লক্ষ চারা গাছ লাগানো হয়, কিন্তু পরিচর্যার অভাব আর অবহেলার কারণে এসব গাছ আর বেড়ে উঠতে পারে না, এতে করে হয় তারা প্রাণীর খাদ্য হয়, নয় তো নির্মাণকাজে বলির পাঁঠা হতে হয়। একটা গাছকে বেড়ে উঠতে না দিলে সে কিভাবে আমাদের ছায়া দেবে? যোগাবে অক্সিজেন? উপহার দেবে নির্মল পরিবেশ? একটা পরিবারে যখন সন্তান জন্ম নেয়, তখনই কি পরিবারটি তাদের দায়িত্ব শেষ করে দেয়? অবশ্যই না। পরম যত্নে আর আদরে বড় করে তোলে সেই সন্তানকে। সেই সন্তানই বড় হয়ে পরিবারের দায়িত্ব নেয়। একটা গাছের ক্ষেত্রেও কি তেমন হওয়া উচিত নয়? আমরা চারা গাছ যেমন দায়িত্ব নিয়ে লাগাই সেই দায়িত্ব প্রসারিত হোক গাছটির বড় হয়ে ওঠা পর্যন্ত। পানি দিয়ে, সার দিয়ে পরম যত্নে নিয়মিত পরিচর্যায় গাছটিকে বেড়ে উঠতে দিতে হবে আমাদেরই। তবেই না সে প্রতিদান দেবে আমাদের- ছায়ায়, অক্সিজেনে কিংবা বাহারী ফলফলাদিতে ।
আমার অভিজ্ঞতায় ফিরি। লকডাউনের কারণে মাস চারেক হতে চললো ঘরবন্দী জীবনের। নানান কাজের ভীড়েও এই সুযোগে বাসার ছাদে নানান জাতের সবজি গাছ লাগিয়েছি মা-ছেলে মিলে। নিয়মিত পরিচর্যায় সে গাছ বড় হয়ে উঠেছে, খাদ্য উপযোগী হওয়ায় সেখান থেকে সবজি রান্নাও করা হয়েছে। নিয়মিতই সতেজ এবং তরতাজা সবজি পেতে বাড়ির আঙিনায় এমন সবজির গাছ লাগানো বোধহয় কঠিন কোনো কাজ নয়। সবুজের পরিবেশ মনও ভালো করে তুলবে, লকডাউনের মানসিক স্বাস্থ্য সুরক্ষায় যেটি রাখতে পারে বড় ভূমিকা।
শেষে এসে এই পৃথিবীর সুস্থতার প্রার্থনাই করতে চাই। পৃথিবী একদিন ভাইরাসমুক্ত হবে। শহর থেকে গ্রামে সবুজ আর নির্মল বাতাসের গানে মুখরিত হবে আমার আপনার আমাদের সকলের চেনা পরিবেশ। প্রকৃতির ভালো থাকায় সকলকে এগিয়ে আসার আহ্বানে জ্বলুক তারুণ্যের দীপশিখা।