এইচ এম সিরাজ:
বিবেক সর্বোচ্চ আদালত। আমরা প্রায় সকলেই কথাটা জানি, কিন্তু মানি কি? বিবেক জয়ী হলেই হারিয়ে যায় চাটুকারিতা। আজকাল আমরা চারপাশে কি দেখছি? ‘বাঘের ওপর টাক’ বলে একটা কথা আছে। প্রবাদসম এই কথাটি সেই বাল্যকাল থেকেই শুনে-জেনে আসছি। কিন্তু এর সঠিক প্রকাশগত অর্থটা সত্যিকারার্থে আমার অজানা। যদিও আর দশজনের মতো আমিও কথাটি ব্যবহার করি বৈকি? কিন্তু ইদানিংকালে অহরহ প্রবাদের কথাটি একেবারে যুতসই রকমেই খাটছে। সমাজের প্রায় সর্বত্র এজাতীয় লোকেরই সরব উপস্থিতি।
আমি সাদাকে সাদা, কালোকে কালো-ই বলি। এমনটা বলতে শিখেছি দীক্ষা প্রদানকারীদের কাছ থেকেই। সেই মক্তবে শেখা একটা শব্দের ব্যবহারকে বিশ্ববিদ্যালয়ে গিয়েও করতে পারিনি এতটুকুনও প্রত্যাখ্যান। আর করবোই-বা কেন? নৈতিকতার এই পাঠটি তো সর্বোচ্চ বিদ্যাপীঠেও ঠিক তেমনটাই পেয়েছি। উপরন্তু সঙ্গে সংযুক্ত পেয়েছি আরো অকাট্য রকমের প্রমাণাদিও। এতে করে মক্তবের ওই শব্দটা আরো অধিক পরিমাণেই হয়েছে শানিত। ফলে তিলকে তাল কিংবা তালকে তিল জ্ঞান করার মতো সুযোগ বন্ধ হয়েছে আরো অধিক পরিমাণেই।
চোরকে আমি কদাচ সাধু আর সাধুকে কদ্যপিও চোর বলি না। সাধুজনকে আমি মুক্তকন্ঠে সাধু, আর চোরকে উচ্চকন্ঠেই চোর বলতে অধিকতর ভালোবাসি। অবশ্য স্থান-কাল ভেদে কদাচ হয়তো নামোচ্চারণ করা থেকে নিজেকে বিরত রাখি, এই যা। নেহায়েতই তর্কে জেতার মানসে কদ্যপিও কারো গায়ে কোনো তকমা জুড়ে দিতে নেই। এমনটা মোটেও যুক্তিসঙ্গত নয়। তদ্রুপই কাউকে মাত্রাতিরিক্ত তোয়াজ করাটাও একেবারেই অনুচিত। অতি অন্ধভক্তিতে যারা অসাধুজন তথা চোরকে সমর্থন করে বা করবে তাদের মোহ একদিন কাটবে-ই, কাটবে। আর তখন তারা ঠিকই সঙ্গোপনে হলেও অনুতপ্ত হতে পারবেন, এটা সুনিশ্চিত। কেননা, মিথ্যাকে কদ্যপিও টিকিয়ে রাখা যায় না।
সত্যকে কস্মিনকালেও লুকানো যায় না। এটাই চিরন্তন বাস্তবতা। ‘সত্য কভুও চাপা থাকে না।’ এই সাদাসিদে কথাটা আমরা কেই-বা না জানি? কিন্তু হয়তো প্রয়োগ করার বেলায় নানান ছুতোয় কদ্যপি এর উল্টো করিও বটে। আমার একান্তই চেনা-জানা কতেকজন আছেন, যাদের আপনজন ভাবা ছাড়া কোনোও গত্যন্তর নেই। তারা হঠাৎ করেই যে কারোরই অসম্ভব আপন সাজতে বেশ তরিৎকর্মা। আবার কিয়ৎ সময় অতিক্রান্তের পরে এই তিনারাই যেন কোথায় বেমালুম হারিয়ে যান! যাদের অতি নিকটজন সেজেছিলেন, আচমকাই এক্কেবারেই দূরের হয়ে গেলেন! নিতান্ত প্রয়োজনের তাগিদে এমনটি হওয়ার বিষয়টি তখন কি আর কোনোভাবেও লুকোছাপা থাকে? এজাতীয় মানুষদের পরিচয় একটাই হতে পারে, আর তা হচ্ছে স্বার্থান্ধ।
দু’মুখো মানুষেরা দিনান্তে বিপাকেই পড়েন, তা চিরন্তন। তারা ‘পল্টিবাজ’ মানুষ হিসেবেও অপরের কাছে বেশ পরিচিত। যদিও তারা নিজেদেরকে বেশ বুদ্ধিমান জ্ঞান করে থাকেন। বাস্তবিকে তারা হয়ে থাকেন চতুর, কিন্তু বুদ্ধিমান কভুও নয়। তারা আজ আপনার পক্ষের লোক তো, কালকেই অপরজনের। সত্যিকারার্থে এই জাতীয় লোকেরা কদ্যপিও কারো পক্ষের তো নয়ই, এমনকি তারা নিজেদেরই খুব একটা আপনজন নয়! সুযোগ পেলেই তারা অন্যের পিছে কাঠি করার কাজটি করে অত্যন্ত নিপুণভাবেই। ওইসব কথিত আপনজন সাজা লোকগুলো যে অপরের সাথে গুটিবাজি করতে যেয়ে আরো অধিক পরিমাণেই পর হয়ে যাচ্ছেন, সেদিকে খেয়াল করার মতো সময়-সক্ষমতা হারিয়ে ফেলেন নিজেরই অজান্তে।
‘উপরে ফিটফাট, ভেতরে সদরঘাট।’ এ কথাটায় বেশ দম আছে বটে। তাইতো মানুষ এটাকে যথেষ্ঠ পরিমাণে গুরুত্ব দেয়। নিজে ‘মাকাল ফল’ হলেও, বুঝাতে চায় মহামূল্যবান! এহেন কর্মে অনেকেই হতে চাহেন পারদর্শী। ভাড়া করা বুদ্ধির জোরেও এমনটি হতে চান। তা হতে না পারলে হয়তো রাজ্যের ক্ষতি হয়ে যাবে বলেই মনে করেন! কিন্তু এটা কদ্যপিও মানতে নারাজ যে, চাটুকারিতায় নয়, জয় সদায় সত্যেরই হয়। সত্য সে যে কঠিন, কঠিনেরেই আমি ভালোবাসিলাম। কারণ সত্য কভুও করে না বঞ্চনা। জয় সর্বদা সত্যেরই হয়।